ছোট্টবেলায় তিতিরের সঙ্গে আমার দুটো খেলা খুব জমত। এক হল ‘আমি একরকম তুমি একরকম’
হাঁটা। এটা এখনো মাঝে মাঝে খেলি। হয় কি, দুজনে রেসের মত পাশাপাশি দাঁড়াই। তারপর
তিতির ‘ওন তু থী স্তাত্’ বললেই দুজনকে যথাসম্ভব বিদঘুটে ভঙ্গীতে হেঁটে ঘরের
অপরপ্রান্তে যেতে হয়। ধর আমি কত্থক নাচুনির মত গোড়ালি ঠুকে ঠুকে গেলুম, তো তিতির
মল্লবীরের মত ঘুঁষি পাকিয়ে একবার বাঁদিক একবার ডানদিক ঘুরতে ঘুরতে। আমি তেলমাখা
বাঁশের বানরের মত তিন পা এগিয়ে এক পা পেছিয়ে তো তিতির চোখ আধখানা বুজে কনুই ভেঙ্গে
বগ দেখাতে দেখাতে। আমি কুচকাওয়াজের মত ‘আইক্ দোম্ আইক্’ বলতে বলতে ধুপধাপ করে
তো তিতির জাপানী কায়দায় কুরনিশ ঠুকতে ঠুকতে। এইরকম।
(ভাল কথা, ‘আইক্ দোম্ আইক্’টা কিন্তু আমার
মস্তিষ্কপ্রসূত নয়! ছোটবেলায় পাড়ার মাঠে খেলতে যেতুম। একটা ইনফরমাল ক্লাব ছিল।
সেখানের পাঁচুদা আমাদের প্যারেড করাতো বাজখাঁই গলায় ঐ ‘আইক্ দোম্ আইক্’ বলে।)
আরেকটা আমরা যেটা খেলি সেটা হল ‘লুকু-লুকু’।
মানে লুকোচুরি। আরেকটু ছোটবেলার কথা বলছি, তিতির করত কি, হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে
খাটের পিছন, কি দরজার পাশ, কি টেবিলের নিচ – দেখিয়ে দিয়ে বলত ‘তুমি ঐখানে লুকোবে’।
তারপর ঠিকঠাক লুকিয়েছি কিনা তা তদন্ত করে, হাত পা চুল কিছুমাত্র দৃষ্টিগোচর থাকলে
সেটা সযত্নে আড়ালে গুঁজে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ‘ওন তু...তেন্’ গুনতে যেত। তারপর পা
টিপে টিপে এসে, যথোচিত আড়ম্বর সহকারে খুঁজে বার করত। আর নিজে লুকোলে তো আর চমৎকার –
একে তো উটপাখির মত শুধু মুন্ডুটা লুকোত। দেওয়াল আলমারির পাল্লার ফাঁক দিয়ে, সোফার
পাশ থেকে, পর্দার পিছন থেকে দু্টো কচি কচি পা তো বেরিয়ে থাকতই, সদাচঞ্চল হাত দুটোও
প্রকাশ্যে কিলবিল করত। তাও যদি না দেখার ভান করে খোঁজার চেষ্টা করতুম, চিকণ গলা খিলখিল
করে বেজে উঠত, “মা, মা, এখেনে দেকো...এইযযে”।
তিতির আরেকটু বড় হতে, এক রোববার চক নিয়ে গিয়ে,
নিচের ব্যাডমিন্টন কোর্টে ঘর কেটে এক্কা দোক্কা শেখালুম। খুব খেলল তিড়িং তিড়িং
করে। তার পরের রোববার, দোকান যাবার জন্য বেরিয়ে, তিতির আমায় নতুন খেলা শেখাল।
"মা খুব সোজা...আমরা না
পাতায় পা দেব না। দিলেই আউট!"
মা
তো অকুতোভয়। হলই বা কাঁধে জলের বোতল আর পা জখম - কদিন আগে দরজার পাল্লায় চেপটে
গিয়ে মাঝের আঙুলটায় এখনো ঝিনঝিনে ব্যথা - খেলার নাম শোনামাত্র সেও এক পায় খাড়া|
চলল
দুজনে তিড়িং বিড়িং! মেয়ের ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল চলার তালে তালে নাচছে, মার চশমা ঢালু নাক বেয়ে
নেমে আসছে বলে তাকে ঠেলে দিতে হচ্ছে বারবার। শীতের মিঠে রোদ। বেশ গান এসে যায় 'ঝরাপাতা গো আমি তোমারই
দলে...
ওঃ হো, পাতা ঝরার ই সময় তো বটে।
গোটা রাস্তার ফুটপাথ জুড়ে, যদ্দূর চোখ যায়, অশথ পলাশের সাথে খিরিশের কুচো কুচো
পাতায় নিবিড় ভাবে ভরে আছে। পাতা না মাড়িয়ে এর মাঝ দিয়ে যাই কি প্রকারে? মেয়ের তো পুঁচকে পা, দিব্যি যাচ্ছে সট্ সট্ করে
ফাঁক খুঁজে খুঁজে। এই ধুমসো পা রাখার জায়গা কই!
এহ্, তাই বলে আউট হব নাকি! অতএব চাদ্দিকের ভ্যাবাচাকা
লোকজনের পরোয়া না করে এক মোটাসোটা মহিলা ফুটপাথে কখনো 'গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা
খাপ পেতেছেন গোষ্ঠমামা' স্টাইলে পা টিপে টিপে, কখনো কোলাব্যাঙের মত লাফ মেরে মেরে, কখনো ব্যালেরিনার মত বুড়ো
আঙুলে ভর দিয়ে.. চলল।
হ্যাঁ মশাই, পুরো ফুটপাথ এইভাবে হেঁটেছি, আউট করতে দিইনি!
এত কষ্ট করে পৌঁছনোর পর তিতিরের স্নেহার্দ্র
বাণী, "ছোট পাতাগুলো তো আপ্পুলিশ, ওগুলোয় পা দিলে কিচ্ছুই হয় না|"