Monday, 27 June 2016

খেলাধুলো


    ছোট্টবেলায় তিতিরের সঙ্গে আমার দুটো খেলা খুব জমতএক হল ‘আমি একরকম তুমি একরকম’ হাঁটা। এটা এখনো মাঝে মাঝে খেলি। হয় কি, দুজনে রেসের মত পাশাপাশি দাঁড়াই। তারপর তিতির ‘ওন তু থী স্তাত্‌’ বললেই দুজনকে যথাসম্ভব বিদঘুটে ভঙ্গীতে হেঁটে ঘরের অপরপ্রান্তে যেতে হয়। ধর আমি কত্থক নাচুনির মত গোড়ালি ঠুকে ঠুকে গেলুম, তো তিতির মল্লবীরের মত ঘুঁষি পাকিয়ে একবার বাঁদিক একবার ডানদিক ঘুরতে ঘুরতে। আমি তেলমাখা বাঁশের বানরের মত তিন পা এগিয়ে এক পা পেছিয়ে তো তিতির চোখ আধখানা বুজে কনুই ভেঙ্গে বগ দেখাতে দেখাতে। আমি কুচকাওয়াজের মত ‘আইক্‌ দোম্‌ আইক্‌’ বলতে বলতে ধুপধাপ করে তো তিতির জাপানী কায়দায় কুরনিশ ঠুকতে ঠুকতে। এইরকম।

(ভাল কথা, ‘আইক্‌ দোম্‌ আইক্‌’টা কিন্তু আমার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়! ছোটবেলায় পাড়ার মাঠে খেলতে যেতুম। একটা ইনফরমাল ক্লাব ছিল। সেখানের পাঁচুদা আমাদের প্যারেড করাতো বাজখাঁই গলায় ঐ ‘আইক্‌ দোম্‌ আইক্‌’ বলে।)

আরেকটা আমরা যেটা খেলি সেটা হল ‘লুকু-লুকু’। মানে লুকোচুরি। আরেকটু ছোটবেলার কথা বলছি, তিতির করত কি, হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে খাটের পিছন, কি দরজার পাশ, কি টেবিলের নিচ – দেখিয়ে দিয়ে বলত ‘তুমি ঐখানে লুকোবে’। তারপর ঠিকঠাক লুকিয়েছি কিনা তা তদন্ত করে, হাত পা চুল কিছুমাত্র দৃষ্টিগোচর থাকলে সেটা সযত্নে আড়ালে গুঁজে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ‘ওন তু...তেন্‌’ গুনতে যেত। তারপর পা টিপে টিপে এসে, যথোচিত আড়ম্বর সহকারে খুঁজে বার করত। আর নিজে লুকোলে তো আর চমৎকার – একে তো উটপাখির মত শুধু মুন্ডুটা লুকোত। দেওয়াল আলমারির পাল্লার ফাঁক দিয়ে, সোফার পাশ থেকে, পর্দার পিছন থেকে দু্টো কচি কচি পা তো বেরিয়ে থাকতই, সদাচঞ্চল হাত দুটোও প্রকাশ্যে কিলবিল করত। তাও যদি না দেখার ভান করে খোঁজার চেষ্টা করতুম, চিকণ গলা খিলখিল করে বেজে উঠত, “মা, মা, এখেনে দেকো...এইযযে”।

তিতির আরেকটু বড় হতে, এক রোববার চক নিয়ে গিয়ে, নিচের ব্যাডমিন্টন কোর্টে ঘর কেটে এক্কা দোক্কা শেখালুম। খুব খেলল তিড়িং তিড়িং করে। তার পরের রোববার, দোকান যাবার জন্য বেরিয়ে, তিতির আমায় নতুন খেলা শেখাল।

"মা খুব সোজা...আমরা না পাতায় পা দেব না। দিলেই আউট!"

   মা তো অকুতোভয়। হলই বা কাঁধে জলের বোতল আর পা জখম - কদিন আগে দরজার পাল্লায় চেপটে গিয়ে মাঝের আঙুলটায় এখনো ঝিনঝিনে ব্যথা - খেলার নাম শোনামাত্র সেও এক পায় খাড়া|

   চলল দুজনে তিড়িং বিড়িং! মেয়ের ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল চলার তালে তালে নাচছে, মার চশমা ঢালু নাক বেয়ে নেমে আসছে বলে তাকে ঠেলে দিতে হচ্ছে বারবার। শীতের মিঠে রোদ। বেশ গান এসে যায় 'ঝরাপাতা গো আমি তোমারই দলে...

   ওঃ হো, পাতা ঝরার ই সময় তো বটে। গোটা রাস্তার ফুটপাথ জুড়ে, যদ্দূর চোখ যায়, অশথ পলাশের সাথে খিরিশের কুচো কুচো পাতায় নিবিড় ভাবে ভরে আছে। পাতা না মাড়িয়ে এর মাঝ দিয়ে যাই কি প্রকারে? মেয়ের তো পুঁচকে পা, দিব্যি যাচ্ছে সট্ সট্ করে ফাঁক খুঁজে খুঁজে। এই ধুমসো পা রাখার জায়গা কই!

   এহ্,  তাই বলে আউট হব নাকি! অতএব চাদ্দিকের ভ্যাবাচাকা লোকজনের পরোয়া না করে এক মোটাসোটা মহিলা ফুটপাথে কখনো 'গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা খাপ পেতেছেন গোষ্ঠমামা' স্টাইলে পা টিপে টিপে, কখনো কোলাব্যাঙের মত লাফ মেরে মেরে, কখনো ব্যালেরিনার মত বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে.. চলল।

   হ্যাঁ মশাই, পুরো ফুটপাথ এইভাবে হেঁটেছি, আউট করতে দিইনি!

এত কষ্ট করে পৌঁছনোর পর তিতিরের স্নেহার্দ্র বাণী, "ছোট পাতাগুলো তো আপ্পুলিশ, ওগুলোয় পা দিলে কিচ্ছুই হয় না|"

Monday, 20 June 2016

এল-ও-এন-ডি-ও-এন


    তিতিরের লন্ডন বেড়ানোর গপ্পো বলি এবার খুব বেড়ানো হয়েছে বটে সেই কোন পুঁচকিবেলা থেকে গেয়ে আসছেলন্ডন বিজ ইজ ফলিং ডাউন’ – শেষ অবধি সেই লন্ডনে আসা হল! তিতিরের বাপি তো মেয়েকে সব্বার আগে ওই লন্ডন ব্রীজই দেখাতে নিয়ে গেল যদিও লন্ডন ব্রীজ না, ওই ছড়ার সাথে সর্বত্র যেটার ছবি দেয় সেটা হল টাওয়ার ব্রীজ তো আমরা তো মহানন্দে দুটোতেই টং টং করে হেঁটে বেড়ালাম সঙ্গে তিতিরের উদাত্ত গলায় ছড়া, বলাই বাহুল্য ব্রীজটা যে মোটেই ফলডাউন করে দেখাল না, তাতে তিতির বেশ একটু ইয়ে কি বলে, মনঃক্ষুণ্ণই হয়েছিল

   আরেকদিন যাওয়া হল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম দেখতে উরি বাবা, কত্ত কত্ত ডাইনোসর! ডাইনোসরের কঙ্কাল, ডাইনোসরের ডিম, ডাইনোসরের হাড়গোড়, অবিকল আসলের মত দেখতে প্রমাণ সাজের মডেলসেটা আবার বিকট হাঁকডাক করে শেষেরটা দেখে তিতির প্রথমে একটু মা-এর কাছে সিঁটিয়ে গেছিল, ওটা যে খেলনা, তিতিরের গান-গাওয়া কচ্ছপের মত ব্যাটারিতে নড়ছে আর লুকোনো মাইক থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে সেটা মা বুঝিয়ে দেওয়ার পর অবশ্য ভয়টা কেটে গেল শুধু ভয় কেটে গেল বললে কম বলা হয়, তিতির সেকশন থেকে বেরোনোর সময় মাকে ফরমায়েশ করল, ‘মা, আমার না, এরকম সব মিছিমিছি ডাইনোসর না, ভাল্লাগছে না তুমি আমায় চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়ে আসল ডাইনোসর দেখাবে একদিন, কেমন?’ (বুঝুন মশাই, বুঝুন ক্লায়েন্ট রিকোয়ারমেন্ট কি ইউজার রিকোয়ারমেন্ট সামলানো এর চেয়ে ঢের ঢের সহজ বাপু!)

   ঐখানেই আরেক অংশে নীল তিমির কঙ্কাল রাখা আছে, পাশে আবার সেইরকম প্রমাণ সাইজের মডেল ঝুলছে আমি তো দেখেই প্রমাদ গুনেছি, এক্ষুনি বলবে অ্যাকোয়ারিয়ামে নিয়ে গিয়ে সত্যিকারের তিমিমাছ দেখাবে তা বলল না , কিন্তু অনেকক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখে বলল, ‘মা , তিমিমাছটার কঙ্কালটা যে বার করে নিয়েছে, ওর দুক্ষু হচ্ছে না?’

   আরেকদিন যাওয়া হল গ্রীনিচ থেমসে নৌকো করে ভেসে ভেসে নৌকোর চমৎকার হাস্যরসমিশ্রিত কমেন্ট্রি বোঝার বয়েস তিতিরের হয়নি, কিন্তু জল, ঢেউ, ভাসমান বয়া, অন্য নৌকো এসব দেখতে তার আগ্রহ কিছু কম নাকি! যেমন সুন্দর জলযাত্রা, তেমনি আবার সবুজ চোখ জুড়োনো গ্রীনিচের ঢালু মাঠ কয়েকটা সাহেব ছানা গড়গড় করে সেই ঢাল বেয়ে গড়াচ্ছিল মা উৎসাহ দিতেই তিতিরও পরম উল্লাসে তাদের পাশাপাশি ঠিক কুমড়োগড়ান গড়িয়ে গেল একবার করে এইসা মজা পেল, তারপর আর আসতেই চায় না! খালি বলে রল ওবার’ (রোল-ওভার) করব!

   ওয়ারউইক কাসলটার কথাও বলা উচিত এইটা তিতিররা গেছিল উজানদাদাদের সাথে ডাগর চোখ করে জীবনে প্রথম কাসলদেখল মেয়ে বেই-বেই’ ভালোবাসা মার কল্যাণে দুর্গ বা গড় জিনিসটা আগেও দেখেছে, মহারাষ্ট্রে তো জিনিসটার অভাব নেই! কিন্তু সেখানে কি এইরকম ছবির মত সাজানো ঘরদোর, অস্ত্রশস্ত্র, গগনচুম্বী টাওয়ার ও তার ইস্ক্রুপ-সম প্যাঁচালো সিঁড়ি (তিতির আর তার মা পুরো চড়েছে, হুঁ হুঁ বাবা, যদিও নামার সময় মনে হচ্ছিল হাঁটুটা খুলে ব্যাগে পুরে নিলেই ভাল হয়!), রঙ্গিন কাঁচের জনালা, ইঞ্চি মেপে বানানো বাগান, সেখানে পালে পালে ময়ূর তারা আবার এত ঘন ঘন বিনা মেঘে পেখম মেলে যে ট্রেনিং দেওয়া কিনা সন্দেহ হয় এসব কিছু আছে? না কি এরকম জম্পেশ সাজপোশাক করা আঙ্কল-আন্টি রা ঘুরে বেড়ায়? দরজা দিয়ে ঢুকছ, পাশ থেকে মিষ্টি হেসে গ্রীটিংস বলছে যে আন্টিটা তার মাথার ওপর খোঁপাটা বোধহয় তিতিরের থেকে বড়! সামনের মাঠে এক ভয়ঙ্কর গোঁপ-দাড়িওলা আঙ্কল, লাল ভেলভেটের কুটকুটে দেখতে পোশাক পরে, হাতে একটা কাঠের তরোয়াল ঘুরিয়ে হুহুঙ্কার ছাড়ছে নিতান্ত হাত পা ছড়িয়ে ঘাসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছ তো পিছনে কোথথেকে এসে পিঠ ছাপানো সোনালি চুল হাওয়ায় উড়িয়ে, পুরো সোনালি বর্ডার দেওয়া সাদা পাশবালিশের খোল মার্কা জামা পরে গীটার হাতে গান গাইতে লেগে গেল আরেক আঙ্কল মানে, একদম থ্রীলিং ব্যাপারস্যাপার যাকে বলে!

    হ্যাঁ, আরেকটা জায়গা গেছিলাম আমরা কেন্সিংটন পার্ক পুরোদস্তুর জগৎ পারাবার মাঝে শিশুরা করে খেলামার্কা জায়গা! খালি পারাবারের বদলে, রাশি রাশি বালি ছড়ানো বিস্তীর্ণ এক খেলার মাঠের মাঝে  দাঁড়িয়ে আছে একটা ইয়াব্বড় আস্ত কাঠের জাহাজ আর তার ডেকে চরে বেড়াচ্ছে, নানাবিধ জানলা দিয়ে উঁকি মারছে, রেলিং এর ওপর আধখানা পেট আব্ধি ঝুলে পড়ছে, দড়ির ব্রিজ বেয়ে সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে, এমনকি পিলে চমকানো স্টান্ট করে এক হাতে জাহাজের কানা ধরে ঝুলছে ধুপধাপ পড়ে যাচ্ছে নানা বয়েসের, নানা দেশের, নানা চেহারার শিশুর দল তিতির জ্যা-মুক্ত তীরের মত সাঁ করে তাদের দলে ভিড়ে গেল খানিক পরে দেখি একটি স্প্যানিশ পোলাকে বিশুদ্ধ বাংলায় ধমকে হটিয়ে স্টিয়ারিং হুইলটি বাগিয়ে তিনি জাহাজ চালাচ্ছেন জাহাজ ছাড়াও, সেখানে কাঠেরই খেলনা বাড়ি, গাড়ি, ঘোড়া আরো কত কিছু খেলনাছিল ছোট্ট ছানাদের খেলার আদর্শ জায়গা, যাই বল!

    আরেকদিন গেলাম সায়েন্স মিউজিয়ামে। সেসব কান্ডকারখানা তিতির খুব বড় হাঁ করে দেখল। সবচেয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখল ঘূর্নায়মান পৃথিবী, আর স্পেসশীপ আর চন্দ্রযানের মডেল।

    লন্ডনে শেষ বেড়ানোটা হল সী ওয়ার্ল্ডে অক্টোপাশ, সী হর্স, স্টারফিশ এসব আগেও দেখেছে তিতির কিন্তু এখানের মত এত সুন্দর আর বড় অ্যাকোরিয়ামে নয় আর এরকম শার্ক? একটা বিশেষ হোঁৎকামুখো শার্ক কে তিতিরের ভারি পছন্দ হয়েছিল সে নাকি ঘুরে ঘুরে ওকে দেখতে আসছিল তার নাম দেওয়া হয়েছিল গম্ভীর শার্ক (মুম্বাই ফিরে এসে দেখি তিতির গম্ভীরভাবে সবাইকে নানাবিধ গল্পের সাথে এটাও বলছে ম্যায় অট্টোপাশ, সী হস, স্তারফিশ আউর গম্ভীর শাক্ক দেখা হ্যায়’, লোকে প্রত্যেকবার লাস্ট আইটেমটায় ঘাবড়ে যাচ্ছে, আমাদের বোঝাতে হচ্ছে) তবে এখানকার সেরা প্রাপ্তি হল পেঙ্গুইন স্কটল্যান্ডে সীলমাছ দেখা হয়েছিল, আর এখানে পেঙ্গুইন দেখতে পেয়ে ষোলকলা পূর্ণ হল। পেঙ্গুইনরা জলে সাঁতার কেটে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, হেলেদুলে লাইন করে হেঁটে, আবার জলে ঝাঁপ দিয়ে আমাদের প্রভূত মনোরঞ্জন করল

   লন্ডনের আরো গপ্পো বাকি রয়ে গেল, উজানদাদার বাড়ির গল্প, জলদস্যুদের গল্প, স্পেসশীপের গল্প – সেসব আবার আরেক কিস্তিতে হবে এখন!