কন্যা বড় হইতেছেন। আমার যেমন একটি হুল্লোড়ে
আড্ডাবাজ বন্ধুর দল আছে, তিতিরেরও তেমনি একটা বেশ খেলুড়ে বন্ধুর দল জুটে গেছে
এদ্দিন এ বাড়িতে থাকায়। সেই পেঁপেগাছের গল্পে বলেছিলুম না তাদের কথা? তিতিরের বিকেল
মানেই তাড়াতাড়ি দুধ-টুধ খেয়ে নিয়ে, একটা ফুটবল কি ক্রিকেট ব্যাট কি ছোট্ট টেডি
বগলে নিয়ে নিচে গিয়ে হাঁকডাক করে তাদের বাইরে আনা। তারপর সেই নানা বয়েসী খুদেরা
দঙ্গল ব্যাডমিন্টন কোর্ট জুড়ে দাপাদাপি করে বেড়ায় অন্ধকার না হয়া অবধি।
কি যে খেলে তা বলা ভারি মুশকিল। মানে ক্রিকেট
ব্যাট দিয়ে এরা বোধহয় ক্রিকেট ছাড়া আর সব কিছু খেলে ফেলতে পারে, গদার মত ব্যাট
বাগিয়ে মারামারি, মাটি-বালির পাহাড় বানিয়ে তাতে ব্যাট পুঁতে দিয়ে পতাকা বানানো,
মায় কনুই এর ওপর ব্যাট ব্যালান্স করতে করতে হাঁটার কম্পিটিশন অবধি। কিংবা ফুটবল
হয়ে যায় উটপাখির ডিম। কিংবা তিতিরের টেডি আর সজলের ডাইনোসরের মধ্যে মুংলি বনাম শের
খান টাইপের যুদ্ধু চলে।
আবার কোন কোন দিন, খেলার জের বাড়ি অবধি গড়ায়।
মানে হয়তো বৃষ্টি এসে গেছে, কিংবা খেলে আশ মেটেনি, তিতিরের সাথে তার কোন বন্ধুও
বাড়ি এসে হাজির হয় আরো খেলবে বলে। আমি অবশ্য তাতে ভারি খুশি হই, তারাও কেন জানি না
আমায় আরেকটা খেলার সাথী হিসেবেই গণ্য করে। কিন্তু মাঝে মাঝে নাজেহালও কিছু কম হই
না এসব দিনে। কিন্তু সেটা বলার আগে আরেকটা ভারি মজার কথা মনে পড়ে গেল এই বন্ধুর
খেলতে আসা নিয়ে, সেটা আগে লিখেছি বলে তো মনে পড়ছে না – টুক করে বলে নিই?
তিতির তখন ছোট। স্কুল যাচ্ছে সদ্য। হিন্দি
ভাষাটা একেবারেই বলতে পারে না, অতি সামান্য বোঝে। তার এক বন্ধু মিহির এসেছে খেলতে।
সে বাংলা জানেই না, বলা বাহুল্য। সে আবার তিতিরের চেয়েও আমার সাথে খেলতে বেশি
ভালবাসত, আর ভাষাসমস্যাটাও ছিল, তাই আমিও তখন ওদের সাথে খেলতুম। তা আমি একটা খেলনা
কুমীর নিয়ে পা টিপে টিপে তার পিছন থেকে আসছি, উদ্দেশ্য মহৎ, চমকে দেব – তিতির ভারি
শশব্যস্ত হয়ে তাকে গিয়ে বলল, ‘পিছনমে দেখো, কুমীর আয়া! তুমকো ভয় দেখাতা হ্যায়।”
ছেলেটি কিন্তু দিব্যি বুঝে গেছিল কি বলা হচ্ছে!
এইবার এখনকার গল্প। আগের হপ্তায় না তারো আগের
হপ্তায় কবে যেন, বাড়ি ফিরেছি গলদ্ঘর্ম হয়ে। বস্তা বস্তা মালপত্তর নিয়ে, কি সে আর
এখন মনে পড়ছে না, হবে কিছু বাজার টাজার, এসে দেখি সজল তার মনীষাদিদির সঙ্গে এসেছে
তিতিরের সাথে খেলতে। আমার যেমন মায়া দেখে তিতিরকে, সজলকে তার মনীষাদিদি সামলায়। সজল
বেশ একটা গুন্ডা ছেলে, মনীষা ভারি নিরীহ শান্ত মেয়ে, কাজেই সজল মনীষাদিদিকে সামলায়
বললেই সঠিক হয় আসলে।
তো সেসব মালপত্তর রেখে টেখে একটু ভাবলুম একটু
বসি, জিরিয়ে নিই। আরে ভাই বয়েস হচ্ছে তো! ও মা, বেশ করে ভিতরের ঘরে বিছানায় গিয়ে
গা এলিয়ে দিয়েছি কি দিইনি, পিছন থেকে খিঁক খিঁক করে হাসির আওয়াজে পিলে চমকে গেল।
ঘুরে তাকিয়ে দেখি, খাটের পিছনে সরু ফাঁকে সজল উবু হয়ে বসে প্রাণপণে হাসি চাপার
চেষ্টা করে যাচ্ছে। বুঝলুম লুকোচুরি খেলা চলছে এদের।
পিঠ ফেলার আশা পরিত্যাগ করে বসার ঘরের সোফায়
গিয়ে বসতে গেছি, দেখি সোফা আর ডিভানের মাঝের খাঁজে মনীষা গুটিশুটি মেরে অদৃশ্য হয়ে
থাকার কঠিন সাধনায় মগ্ন। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে বেচারী এমন লজ্জা পেল, আমি আর
সেখানে বসা উচিত বোধ করলুম না।
বারান্দার দিকে এগোতে গিয়ে মায়ার গলা পেলুম ‘ফাইব,
সিক, সেবেন...’ মানে তিনি চোর হয়েছেন এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনছেন। বিশ্রামের আশা
জলাঞ্জলি দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলুম, কি বলব মশাই বাথরুমটা অবধি বেহাত! সেটার দরজা ‘একটুকু
ফাঁক করে’ তিতির কচ্ছপের মত মুন্ডু বাড়িয়ে দেখছে আন্টি ধরতে এল কিনা।
এর পরও লোকে বলবে আমার সহনশীলতা কম?
তবে আজ বৃষ্টি পড়ছে ঝমাঝম। তিতিরের
মন ভাল নেই, নিচে খেলতে যেতে পারছে না, জল কাদায় বন্ধুরাও কেউ আসতে চাইছে না বাইরে।
জানলা ধরে সোফার পিঠে উঠে বসে আছে আর আপনমনে সেই ছড়াটা বলছে, যেটা আমরাও ছোটবেলায়
বলতুম ছাতের দরজায় দাঁড়িয়ে – ‘যা বৃষ্টি ধরে যা/লেবুর পাতায় করমচা’।
দেখছি, মায়া হচ্ছে, ভাবছি নতুন কি
খেলা বানানো যায়, এমন সময় তিতিরের প্রশ্ন, “মা!! লেবুর পাতা কি কাপের মত?”
একটু সময় লেগেছিল, তারপর বুঝলাম তিতির ছড়াটা বুঝেছে
‘লেবুর পাতায় গরম চা’। যুক্তিগ্রাহ্য প্রশ্ন! মানেটা ঠিক বুঝিয়ে দিতে খুব হাসল
মেয়ে। তারপর আবার জানলা ধরে বসে ঠিক করে শেখা ছড়াটা বলতে লাগল।
মনটা কেমন করে উঠলো, কেন জানি না অপু দুগ্গাকে
মনে পড়ে গেল। আর মনে পড়ল নিজের ছোটবেলা,
এইরকম জানলা ধরে পাশের মাঠের দিকে চেয়ে বসে থাকা, সেই একলা, সরল, গল্পের বই বুকে
নিয়ে কাটানো দুপুরগুলো। ভালবাসার দুপুরগুলো।
তিতির, কবে বই পড়তে শিখবি রে মা! আরো কত্ত কিছু
খেলা বাকি আমাদের, সব কি আর আমি শেখাতে পারব, না বন্ধুরাই পারবে! ঐ বইগুলো ডাকছে
যে!