সেই কার্পেট কান্ডের পর থেকে নিজের ক্ষমতা
ও প্রতিভা সম্বন্ধে ধারণাটা যাকে বলে গগনচুম্বী হয়ে গেছে। কার্পেট কাণ্ড জানেন তো,
সেই যে বন্ধু দেখাল, সামনে কার্পেট বিপজ্জনক রকম উঁচুনীচু হয়ে আছে, আর আমি ধীর স্থির
ভাবে “দেখেছি” বললুম, তারপর নিখুঁত তাক করে সেই লটঘটে পা ঢুকিয়ে রাম-হোঁচট খেয়ে ফেললুম?
তারপর থেকে এটা মোটামুটি মেনে নিয়েছি যে আমি নিজেই জানি না আমি কি কি করতে পারি।
এই যেমন গতকাল। নিদ্রাকাতর
পরিশ্রান্ত অবস্থায় বহুবার নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরেছি রাত্রে। কিন্তু কালকের মত কাণ্ড হয়নি
তো কক্ষণো!
সে এক রহস্যময় ব্যাপার। যদিও
সরাসরি নয়, তবে তাতে তিতিরেরও একটা জরুরী ভূমিকা ছিল বইকি।
হল কি, ফিরে কন্যাকে পরিপাটি
করে শুইয়ে দিয়েছি। দিয়ে নিজে কাঞ্চন-কাঞ্জীভরম মুক্ত হয়ে, ল্যাগব্যাগে নাইটি গলিয়ে,
শুয়ে পড়ার আগে একটু চোখমুখ সাফাই করতে গেছি।
তুলো নিলুম। তাতে অনেকটা
গোলাপজল ঢেলে, কাজল লিপস্টিক ঘাম সব বেশ করে ঘষে ঘষে তুলতে লেগে গেলুম। কপাল থেকে নামতে
নামতে ঠোঁট অবধি পৌঁছেছি, হঠাৎ মনে হল খুব গরম লাগছে।
সেটা তো হবার কথা
নয়! রোজ ওয়াটার দিলে তো একদম ফ্রেশ ফুরফুরে লাগে! তার ওপর শীতকাল, তায় রাতের বেলা –
এমনিই ঠান্ডা লাগার কথা!
ভাবছি আর তুলো
চালাচ্ছি, আর আয়নায় দেখছি মুখটা ক্রমশ আরো আরো আরো চকচকে হয়ে যাচ্ছে!
ভূতুড়ে ব্যাপার নাকি!
হচ্ছেটা কি!
হবে আবার কি! ডাবর
গুলাবারি আর জনসন্স বেবি অয়েল দুটোই একরকম দেখতে গোলাপি ঢাকা দেওয়া শিশি যে! তাদের
মোটেও পাশাপাশি থাকার কথা নয়, কখনোই নয়, কিন্তু তিতির সকালে মায়ের ড্রেসিং টেবিল
গুছিয়ে দিয়েছিল কিনা ভালবেসে!
(এই অবধি পড়ে যাঁরা খ্যাঁকশিয়ালের মত
হাসির মওড়া দিচ্ছে, তাঁরা আরেকটু ধৈর্য ধরে বসুন দিকি।)
এবার আর রাত্তির না, ঘোর দিনের বেলা।
ঘুম পাওয়ার কোন সীন নেই, রীতিমত মাছের বাজার সবজি দোকান সব ঘুরে টুরে চাগিয়ে চাঙ্গা
হয়ে আছি। তৃতীয়বার বেরিয়েছি মুদিখানার সামগ্রী কিনতে। এবারে কন্যারত্নটি লেজুড় হয়ে
এসেছেন সঙ্গে।
“মা মা দ্যাকো দ্যাকো ডাস্টবিন!”
চচ্চড়ে রোদে চরে বেড়াচ্ছি সেই থেকে, দুধ
কফি শ্যাম্পু ইত্যাদি প্রভৃতির এক ভারি ব্যাগ হাতে, চা-তেষ্টায় গলা কাঠ, মাথায় তাড়া
আরো গন্ডাখানেক বিচ্ছিরি কিন্তু জরুরি কাজের, এখন এসব আদিখ্যেতা ভাল্লাগে? ডাস্টবিন
একটা দ্যাখার জিনিস হল? নাকি আমি ইহজীবনে সেটা দেখিনি? বোলে তো, গোটা জীবনটাই কালো
প্যাকেট মুড়ে উক্ত বস্তুতে পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মাঝে মধ্যে! দিলুম এক রাম ধমক -
“চ চ আর ডাস্টবিন দেখতে হবে না!”
মিনিট পাঁচেক চুপ করে পাশাপাশি চলার পর
মেয়ের ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ণ অভিযোগ, “তুমি দেখলেই না! ও কিন্তু আমার ব্যামের ক্লাসে পড়ে।”
‘ব্যামের ক্লাসে’ কি করে পড়া যায়, সে
কি জীবনের নানা ওঠাপড়ার পড়া; মনে তৎক্ষণাৎ উদয় হওয়া এসব কূট প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে
বললুম, “কে? কাকে দেখলুম না?”
“ঐ যে? দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল? মাথায় পাগ্গি?”
আবছা মনে পড়ল, একটি কচি সর্দারবালক ‘মাথায়
পাগ্গি’ সহ দোকানের মুখে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল বটে! আমি তাদের পাশ দিয়েই সড়াৎ
করে ঢুকে মালপত্তর তুলে এনেছি ঝড়ের গতিতে। চলে আসার সময়ে, অতিসজ্জিতা মা-টি যে আমার
দিকে একটি জ্বলন্ত কোপকটাক্ষ নিক্ষেপ করেছিলেন সেটাও মনে পড়ল এইবার। তা নিত্য্ সময়াভাবের
চাপে, এরকম গেরিলা অ্যাটাক আমি করেই থাকি। সবাইই করে। যস্মিন দেশে যদাচারঃ! কিন্তু
সে বালক যে আমার মেয়ের এক্সারসাইজ গ্রুপে ব্যায়ামবীর হবার সাধনায় রত, সে আমি জানব কেমন
করে?
“বলবি তো সেটা! দেখতুম তাহলে।”
“বঁল্লুঁম তোঁ! ঐ যে বল্লুম না, দ্যাকো
‘জসমিন’?”
জসমিন?
জসমিন!!!
জসমিন।
হুম।
ভাবছি আগামী অন্তত এক সপ্তাহ দেরি করে
বাড়ি ফিরব, যাতে কোনমতেই “ব্যামের ক্লাস” ফেরত মাতাপুত্রের সাথে দেখা না হয়।