সক্কাল বেলা, ভাল করে মুখ
ধুইনি পর্যন্ত, “মাম্মা! মাম্মা!!” করে সে কী অনৈসর্গিক আর্তনাদ!
মাম্মাত্ব লাভ করে পাঁচ বছরের
বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এখন যাকে বলে স্থিতপ্রজ্ঞ হয়ে গেছি, কথায় কথায় ভির্মি খাই না
আগের মত। কিন্তু এই আর্তনাদে আমার পেটের পিলে গাঁক করে লাফিয়ে পড়ে
ডায়াফ্রামে ঠুকে গেল, মাথার উস্কোখুস্কো চুলগুলো আলপিনের মত খাড়া-খাড়া হতে গিয়ে বিনুনিতে
বাধা পেয়ে কেমন যেন ছেতরে গেল, আর ফেনামাখা টুথব্রাশটা পটাং করে হাত থেকে বালতির
মধ্যে পড়ে গিয়ে আধ বালতি জল নষ্ট হল।
কোনরকমে মুখ ধুয়ে
দৌড়ে গেলুম শোবার ঘরে। মেয়ে তখনো শয্যাত্যাগ করেনি, সারারাত ঘুমোনোর পরিশ্রম লাঘব
করতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মাত্র। এর মধ্যে এমন কী বা হতে পারে যে এভাবে হুঁকোমুখোর মত
চেঁচাবে! জেগে জেগে তো আর পঙ্গপালের স্বপ্ন দেখে ভয় পেতে পারে না, আর এত বড় ধেড়ে
মেয়ে খাট থেকে পড়ে যেতেও পারে না! এইখানে ভাবনায় লাগাম দিতে হল, কারণ মনে পড়ে গেল
ধেড়েতর হয়েও এই কিছুকাল আগেই আমি মেয়ের সাথে পাইরেট শীপ খেলার হুড়োহুড়ি করতে করতে ‘পপাত
চ’ হয়েছি!
ততক্ষণে মেয়ের
গলা শুনে রান্নাঘর থেকে আন্টি আর বসার ঘর থেকে দাদু সবাই চোখ গোল করে এসে হাজির।
মেয়ে ফিকফিক করে
হেসে বলল, “দাঁত নড়ছে!”
হুম্! এই কথা!
গতকাল বাড়ি ফিরেই এই ঘোষণাটা শুনেছি বটে! তেনার প্রথম দাঁতটি নড়িতেছে।কাল খুব
উল্লাস সহকারে আমায় নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখিয়েওছে। সামান্য কম্পমান, সবে শুরু হয়েছে। তা
সে তো আজ-ও নড়বে বটেই, এ আর নতুন কথা কি!
নাহ্! জীবনে
প্রথম দন্তকম্প দেখা কন্যার কাছে এ এক পরম আশ্চর্য! দাঁত কাল নড়ছিল, আবার আজ-ও
নড়ছে! সেই আহ্লাদেই অত হাঁকডাক।
তারপর আমি তো রকেটের
গতিতে রেডি হয়ে আপিশ চলে গেলুম। আপিশ থেকে ফিরে দেখলুম তিনি পুরো ব্যাপারটা বেশ
হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছেন ততক্ষণে। দাদুমণি বুঝিয়ে বলেছে, তারপর দিম্মাকে “কাইপ্” করে
দেখিয়েছে, তখন দিম্মা আরো বুঝিয়েছে, অবশেষে আন্টিও তার দাঁত পড়ার গল্প শুনিয়েছে।
কাজেই তিনি এখন দাঁত নড়া, দাঁত পড়া, নতুন দাঁত গজানো, বুড়ো বয়েসে আবার দাঁত পড়া,
দাঁত বাঁধানো, ইঁদুরের গর্ত – সব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হয়ে গেছেন।
ইঁদুরের গর্ত
শুনেই তো ফ্যাক করে হেসে ফেললুম। শহরে আবার ইঁদুরের গর্ত! এ বাবদ আমাদের দুই
জেনারেশনের আবার কীর্তিস্থাপন করা আছে। আমার পিতৃদেব এক পোক্ত পালিশ কাঠের আলমারির
নিচে একটা গর্ত আবিষ্কার করে ধরে নিয়েছিলেন সেটা ইঁদুরের গর্ত, এবং তাঁর প্রথম
দাঁতখানি সেই গর্তে সুন্দর করে গলিয়ে দিয়েছিলেন। পরদিন ঠাকুরদাদা আলমারি খুলে
জিনিস বার করতে গিয়ে দেখেন নিচের তাকের মাঝমধ্যিখানে এক মরালশুভ্র দন্তরত্ন শোভা
পাচ্ছে।
আর আমি? আমাদের
কলকাতার বাড়ির শোবার ঘরে একটা জল যাবার ঝাঁঝরি আছে। পুরোনো বাড়ি তো, জল দিয়ে ঘরে
ধোয়া হলে জল বেরোবে বলে রাখা থাকত তখন। ঠিক যেমন দেওয়ালে ঘুলঘুলি আছে, জানলায় খড়খড়ি আছে।
তা সে যাক, আমি সারা বাড়ি পরিদর্শন করে কেন জানি না সেই দোতলার ঘরের ঝাঁঝরিটাকেই
ইঁদুরের গর্ত সাব্যস্ত করেছিলুম। এর থেকে বোঝা যায় ঐ বয়েসে আয়তন নিয়ে কোন আন্দাজ
থাকে না, কারণ যেখানে আমি নধর ইঁদুর ন্যাজ খেলিয়ে ঢুকবে বেরোবে ভেবে নিয়েছিলুম
সেখানে অনেক কসরৎ করেও কচি দাঁতটা ঢোকাতে পারলুম না, এতই সরু ফাঁক। মাঝখান থেকে আবার
দিদা দেখে ফেলে বাড়িশুদ্ধু সবার কি হাসাহাসি!
তো বংশগতি অনুসরণ
করে তিতিরও ইঁদুরের গর্ত খুঁজে রেখেছে দেখলুম। কিছুকাল আগে বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব
হয়েছিল, তখন রান্নাঘরের দরজার কাঠ খানিক চিবিয়ে একটা গর্ত করে দিয়েছিল ইঁদুরে।
মেয়ে সেখানেই নাকি দাঁতটা ফেলবে।
পট্ করে মাথায়
ফিচেল বুদ্ধি এল।
“ও তিতির! ফেলে
দিবি কেন? এক কাজ কর, তোকে একটা বাহারি দাঁতের কৌটো কিনে দিই, তাতে তুলোর বিছানা
করে দেব গয়নার বাক্সে যেমন থাকে। সব দাঁত জমিয়ে রাখিস।”
“তাপ্পর?”
বয়েস বেড়েছে বলেই
কি আর বুড়োটে হতে ইচ্ছে করে, বলুন?
“তারপরই তো মজা!
বুড়ো হয়ে যখন দাঁত পড়ে যাবে, তখন নিজের দাঁতগুলোই আবার লাগিয়ে নিবি।”
হো হো হি হি
খিলখিল খিলখিল। ঘরের সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু পরদিনই আর
হাসি রইল না তাদের। আমার? আমার আবার কি হবে, আমি এসবের ঊর্ধ্বে। তাছাড়া খাল কেটে
কুমিরটা তো আমিই এনেছি!
না, হয়নি বিশেষ
কিছুই। পরদিন তিতিরকে নিয়ে চেম্বুর গেছিলুম কেনাকাটা করতে। লিস্টে “দাঁতের কৌটো”ও
ছিল গুরুত্বপূর্ণ আইটেম। তা অনেক দেখে দেখে, বেছেবুছে, একটা সুন্দর স্বপ্নিল
গোলাপী রঙের কৌটো কিনে এনেছে মেয়ে। বাড়ি এসে তাতে তুলোর আস্তরণও বানিয়ে দিয়েছি।
এইবার, এইমাত্র
তিনি ঘোষণা করেছেন যে যেমন কয়েন ফেলে ফেলে কয়েন-ব্যাঙ্ক “ভত্তি” করছেন, তেমনি এই
কৌটোটাও দাঁতে “অ্যাক্দম ভত্তি” করে দেবেন – এই তাঁর মনোগত বাসনা।
এদিকে কৌটোর যা
সাইজ, তাতে শুধু তিতির কেন, তিতিরের মা দিম্মা দাদুমণি বদ্দিদা ছোদ্দিদা মাসিমণি
মামাবাবু দাদামশাই সবার বত্রিশ পাটি ভরলেও “ভত্তি” হবে কিনা সন্দেহ! বলি এত দাঁত
পাব কোথথেকে শুনি? এরপর যদি কয়েন-ব্যাঙ্ক ভর্তি করার লোভে যেমন বায়না করে করে কয়েন আদায় করছে, সেরকম আমাদের দাঁত ধরেও টানাটানি করে?