Friday 23 November 2018

শার্ক

হাতে দুধের গ্লাস, গোঁফে সূক্ষ্ম সরের প্রলেপ। বিনুনি বাঁধা ডুগডুগ করে নড়া মুণ্ডুটাকে দেখে ভারি মজা লাগছিল। পঞ্চম চুমুকটা দিয়ে গ্লাস রেখেই সুর খেলিয়ে বায়না ভেসে এল, “মা, মঈশাসুর বলো।“
অগত্যা, তাই বলি।
---
মঈশাসুরের খুব ইচ্ছে হয়েছিল একটা “শাক্‌” পুষবে। লালশাক কি নটেশাক নয় গো, ওই যে জলে থাকে, পিঠে তিনকোনা পাখনা, সেইটে! শাআআআআররররররর্ক্কক্কক্কক্‌!
এদিকে দুগগা মা তো বলে দিয়েছে ‘কভ্‌ভি নেহি!” মঈশাসুরটা তো দুষ্টু, করেছে কী, নিজে নিজে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বেবি শার্ক নিয়ে এসেছে...
[পাঁচ মিনিটের বিরতি। ‘বেবি শার্ক টুট্‌ টু টুট্‌ টু টু’ গেয়ে ট্যুইস্ট নাচার জন্য। যারা ছানা নিয়ে এ গান একবারও শুনেছেন তারা বুঝবেন এর মাহাত্ম্য!]
তো, মঈশাসুর তো সেই শার্ক এনে চানের বালতিতে লুকিয়ে রেখেছে। খুব মজা, ‘শাক্‌’ পুষেছে। কিন্তু হল কী...
[এইখানে আবার দুধ ফিনিশ করার বিরতি। মানে বিরতি না দিলে দুধ যেমন কে তেমন পড়ে থাকছিল কিনা।]
শার্কটা ছিল মহাশার্ক প্রজাতির। পরদিন ঘুম থেকে উঠে মঈশাসুর দেখে সে এইটুকু এক বিঘৎ থেকে এক রাত্তিরেই বেড়ে বালতি ভরে ফেলেছে। তারপর দাঁত টাত মেজে দুধ খেয়ে এসে ঘরে ঢুকেই তো ‘আঁই আঁই আঁই’ চীৎকার করে উঠেছে।
শার্ক লম্ফ মেরে বালতি থেকে বেরিয়ে সারা ঘরে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। মঈশাসুরকে দেখেই সে লক্ষ কোটি ধারালো দাঁত বাগিয়ে তেড়ে এসেছে।
আর যায় কই! মঈশাসুর তো ‘বাঁচাও বাঁচাও’ করে সারা বাড়ি দৌড়চ্ছে! তার পিছু পিছু ল্যাজে নেচে নেচে চলেছে সেই বেবি শার্ক! ‘টুট্‌ টু টুট্‌ টু টু’ গান গাইছিল কিনা জানি না, কিন্তু সে সরস্বতী আর গণেশের পড়ার টেবিলে ল্যাজ বুলিয়ে সব বইখাতা ফেলে দিয়েছে, কার্তিকের ফুটবল নাকে করে নাচাতে গিয়ে জানলার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে, লক্ষ্মীর নতুন জুতোর ওপর দিয়ে ঘষে গিয়ে সেটা থ্যাবড়া করে দিয়েছে, আর রান্নাঘরে মুখ বাড়িয়ে দুগগামাকে অ্যায়সা মেছো ভেংচি কেটেছে যে আঁতকে উঠে দুগগামার হাত থেকে ফোড়নডালা পড়ে গিয়ে সারা ঘরে সরষে কালোজিরে গড়াগড়ি যাচ্ছে।
দুগগা মা তো খেপে আগুন! কে এসব বাড়িতে ঢুকিয়েছে অ্যাঁ?
দুগগা মার ওই রেগে কাঁই রূপে হাতা খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসা দেখেই তো শার্কের হয়ে গেছে! সে এদিক দেখে ওদিকে দেখে, দেখে কি জানলার বাইরেই একটা বড় ঝিল। অমনি শার্ক জানলা পেরিয়ে সোজা সেই ঝিলের নিচে। আর মঈশাসুর দশ হাতের কানমলা আর পিঠে গুমগাম কিল খেয়ে চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরে।
---
ওহে, পড়াশুনোটা করো এবার? গালে হাত দিয়ে বসে বসে কী ভাবছ?
এঁ, মা, আট্টু বলবে? ওই শার্কটার তাপ্পর কী হল?
আচ্ছা আগে অঙ্কগুলো হয়ে যাক, এক পাতা হাতের লেখা হোক, একটু বাংলা পড়া হোক।
তারপরে মাতাকন্যার ‘ঘন্টাখানেক সঙ্গে হোমটাস্ক’জনিত প্রবল পরিশ্রমের কথা উহ্য থাকুক। ততক্ষণ শার্কটা খেয়ে দেয়ে আরো মোটা হোক, আরো বড় হোক, আরো পাজি হোক।
আবার তার সঙ্গে দেখা হয় স্নান খাওয়া সেরে দুপুরে শুতে এসে। মায়ের কোলের কাছে ভিজে চুল এলানো কচি মুণ্ডু ঢুকে পড়ে, মিহি মিহি গলায় আবার বায়না ওঠে, “মা? গপ্পো? শার্ক?”
---
একদিন না, দেখা গেল, দুজন লোক সেই ঝিলের ধারে পা টিপে টিপে যাচ্ছে। একটা ছোট সাইজের, বিনুনি বাঁধা, অন্যজন বড়, সালোয়ার কামিজ পরা। বড়জনের হাতে একটা ছিপ।
[একজনের উত্তেজিত হয়ে উঠে বসা ও অন্যজনের তাকে আবার ভুলিয়ে ভালিয়ে শোওয়ানোর বিরতি।]
তারপর তো তারা গুছিয়ে বসেছে ঝিলের ধারে। বগা পুলিশ টুলিশ কেউ নেই দেখে নিয়েছে। ছিপ ফেলেছে।
আর ফেলতে না ফেলতে ছিপে টান!
তুলে দেখে কী...
‘মাছ? মাছ? মা, মাছ?”
একটা ছেঁড়া জুতো। গার্ড আঙ্কলদের কারো। বিচ্ছিরি দেখতে, মুখ হাঁ।
[হাসির বিরতি।]
তারপর আবার ছিপ ফেলেছে। খানিক পরে আবার ঠুকরেছে। অমনি তো মা এক টান। আর দেখে কী...
“এবার মাছ? মা চিংড়ি মাছ?”
দেখে কী একগাদা শ্যাওলা আর ঝাঁঝি। সে কী বদ গন্ধ সেগুলোয় তোকে কী বলব!
[‘ইশ্‌ ইশ্‌’ করে প্রবল হাসির বিরতি।]
যা থাকে কপালে, বার বার তিনবার এসব বলে টলে তো আবার ছিপ ফেলেছে। তা এবারও খানিক পরে ফাতনা নড়ছে।
‘কী গো? মাছ, না এবার?”
হেঁইও হেঁইও করে টেনে তুলে দেখে একটা ফুটিফাটা ছেঁড়া তেরপল। কে কবে ফেলে গেছিল কে জানে।
[এখনো মাছ না পাওয়ায় গোঁসা ও গোঁসাভঙ্গের বিরতি।]
তারপর হল কী , সেই শার্কটা জল থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, রাগ কোরো না তিতিরপাখি। আমি আসলে আজ আমার ঘরে সাফ করছিলুম তো, তাই যা যা জঞ্জাল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছি সব তোমার ছিপে আটকে গেছে।
কেন তুমি অমন করেছ? আমি কী করে মাছ ধরব তাহলে?
তাই তো! কিন্তু সাফ না করেই বা উপায় কী, লোকে এত এসব ফেলে দেয় জলের মধ্যে আমরা তো থাকতেই পারি না।
তারপর? তারপর তিতির শার্ককে ‘হেল্প’ করল এসব জিনিস ছিপ দিয়ে জল থেকে তুলে দিয়ে – জল একদম ‘পোষ্কার’ হয়ে গেল, আর শার্ক তিতিরকে ‘হেল্প’ করল রাশি রাশি মাছ ওর ছিপে গেঁথে দিয়ে।
---
রাশি রাশি মাছের মধ্যে কটা তেলাপিয়া আর কটা চিংড়ি সে হিসেব দিতে গিয়ে দেখি আরেকজন ঘুমের দেশে। ভারি মিষ্টি একগাল ‘বেবি শার্ক’ মার্ক হাসি মুখে নিয়েই।
‘টুট্‌ টু টুট্‌ টু টু’!