তিতিরদের এখনকার বাড়িটা ভারী সুন্দর। ভিতরের ঘরে, দেওয়াল জোড়া জানলার এ পাশের কোনায়
পড়ার টেবিল, ও পাশে বইয়ের আলমারি। টেবিলে থাক দেওয়া মায়ের অধুনাপাঠ্য বইয়ের ফাঁকে ‘তোড়ায়
বাঁধা ঘোড়ার ডিম’, আর আলমারিতে তিতিরের নাগালের তাকে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’। হুঁ হুঁ
বাবা, তিতির জানে!
এই দুইয়ের মাঝের খোলা অংশে, সাদা টালি বসানো মেঝেতে তিতিরের ‘খেলাঘর’। ধুমসো দেড়ফুটিয়া
ট্রাক থেকে হাফ সেন্টিমিটার সাইজের পুঁতি – সব পাওয়া যায় সেখানে তিতির যখন খেলতে বসে।
কোনোদিন বাক্সের উপর বাক্স চাপিয়ে পুলিশ ষ্টেশন হয়, কোনোদিন চিড়িয়াখানা। এই কনস্ট্রাকশন
সাইটে মাটি কাটা গাড়ি আর সিমেন্ট মিক্সার ঘুরে বেড়াচ্ছে, তো এই মেলা বসে বেলুন বিক্রি
হচ্ছে। যেহেতু ক্রীড়াঙ্গনে ওই হাফ কি এক সেন্টিমিটার সাইজের গড়গড়ে জিনিসের বিশেষ প্রাদুর্ভাব,
তাই মা বকের মত ইয়াব্বড় পা ফেলে ডিঙ্গি মেরে হাঁটা চলা করে তিতির খেলতে বসলে।
যদিও তাতেও যে পুরো রেহাই পায় তা নয়।
নিজের কাজে মহাভারত পড়ছে মা। রাজশেখর বসুর মহাভারত রাখা আছে অন্য ঘরে, অন্য
বইয়ের আলমারিতে। উঠে দাঁড়িয়ে পা ফেলতেই সড়াৎ করে বিনা আয়াসে তিন ফুট মত এগিয়ে গিয়ে,
পরম সাবলীল শরীর ও ব্যালান্সিং ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে খাটের কোনায় খটাং করে হাঁটু ঠুলে
ফেলল।
“অ্যাঁ তুমি আমার রাস্তা ভেঙে দিলে!!!”
ত্রিভঙ্গমুরারি হয়ে দাঁড়িয়ে মা তখন পায়ের শুশ্রূষা করছে। সেই বা ছাড়বে কেন,
“তুই যে আমার হাঁটু খুলে দিলি তার বেলা?”
মেয়ের মনে মা-কে নিয়ে প্রবল মায়া, নিজেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণে মহিলার গার্জেনও জ্ঞান
করে সে। অতএব উদ্বেগের হদ্দমুদ্দ হয়ে হাঁটুতে ঠাণ্ডা জল থাবড়ে (কন্সট্রাকশন সাইটে
মশলা-গাড়িতে সিমেন্ট মাখতে জল লাগে তা জানো না? কৌটো করে জল নিয়ে এসে বসতে হয় তার
জন্য), বোরোলীন লেবড়ে, হামি ও ফুঁ দিয়ে তবে ছাড়ল। একটা পুরোনো শাড়ির ছেঁড়া পাড় (বার্বির
শাড়ি) দিয়ে পট্টিও বেঁধে দিতে চেয়েছিল, সেটা আর মা নিতে রাজি হয়নি।
মা খাড়া হয়ে জানতে চায়, ঠিক পায়ের গোড়াতে অতগুলো জুড়ে জুড়ে বানানোর খেলার
পাইপগুলো রেখেছিল কেন?
“ওঁগুলো তো জলের নল, রাস্তা সারাচ্ছি না? খুঁড়ে তুলেছি, রাস্তার ধারে অমন করেই
তো সাজিয়ে রাখার নিয়ম!”
চোখ পাকিয়ে দেখা যায়, রাস্তাই বটে। কী করছিল কে জানে, আপাতত মায়ের চরণকমলের দৌলতে
সারা রাস্তা জুড়ে পর পর পাইপেরা শুয়ে আছে পাশাপাশি।
“তুঁমি আমার রাস্তা ভেঙে দিয়েছ!”
“মোটেই ভাঙিনি, দ্যাখ কী সুন্দর সমান করে দিয়েছি।“
“মা! আইডিয়া! তুমি হচ্ছ রোড রোলার, কেমন?”
সবেগে রাজশেখরবাবুর খোঁজে অন্য ঘরে পলায়ন করা ছাড়া এরপর আর কী বা করার থাকে,
বলুন!
---
মা ল্যাপটপে খুটখাট করছে। তিতির খেলাঘরে মত্ত। বিশাল ব্যস্ততা সেখানে, বার্বির
জন্মদিন হচ্ছে।
“মাঁ? ও মা?”
“হুঁ?”
“তোমার কোন রংটা পছন্দ?”
“তিতিরের রঙ।“
“আরে ধ্যাৎ! রেড, না ইয়েলো, না পিংক...এইরকম!”
“উঁ? দে পার্পল দে।“
খচর মচর হল কিছুক্ষণ। তারপর কাঁধের পাশে খুদে মুণ্ডূ।
“আমার পাপ্পল নেই ওইগুলো। অন্য রঙ বলো।“
চোখ ফিরিয়ে দেখি বাচ্চাদের জুয়েল বানানো কিটগুলোর সমস্ত পুঁতি ঢিবি করে জড়ো
করা। সেফ অপশন বলে দিই, “পিংক”।
খানিক পর খুদে খুদে প্লেটে পিংক ডোনাট, পিংক পাস্তা, পিংক কাস্টার্ড, পিংক কেক
আর পিংক কাপে করে পিংক স্ট্রবেরি শেক দেওয়া হয় আমায়।
“ইকি, জলটা এমন গোলাপি করলি কি করে?”
“সিক্রেট!!!” বলে মেয়ে জলরঙের বাক্সটা ইশারায় দেখায়।
চাকুম চুকুম করে সব খেয়ে ফেলি। আহা, মিছিমিছি। কীইইইইইইই ভালো হয়েছে রে!
গর্বিতা কন্যা দুহাত ভর্তি রবারের পুতুল নিয়ে স্নানার্থে যাত্রা করেন এরপর।
মা আরো কাজ করে। হিসেব মিলছে না দেখে আবার নতুন করে শুরু থেকে শুরু করে। আরো
অনেকক্ষণ খুটখাট করার পর খেয়াল হয় আন্টির দিয়ে যাওয়া চা জুড়িয়ে জল হয়ে যাচ্ছে। মা তখন
পিঠ টান করে আড়মোড়া ভাঙে, চোখ বন্ধ করে একটু ব্রিদিং এক্সারসাইজ করে, তারপর আলতো
করে কাপে একটা লম্বা চুমুক দেয়।
তারপর হাঁকপাক করে বাথরুমে দৌড়য়।
ইয়ে, কাপ গুলিয়ে ফেলে জলরং গোলা জল এক চুমুক খেয়ে ফেললে খুব একটা ক্ষতি হয় না,
বলুন?