Saturday, 9 January 2021

পিজিনিস্তা

 


পিজিনিস্তা…”

রিনরিনে গলার ডাকটা রোদমাখা শীতের সকালে ছড়িয়ে যায়। কাজ করতে করতে চোখ সরিয়ে তাকাই। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে হুড়মুড় করে ওরা এসে গেছে, দেখতে পাই।

ওরা পাঁচজন।

পিজিনিস্তা, পাঈরা-পাঈরা, পিগলু, হ্যারি আর কাগলা।

আমিও ছাতের রেলিং-এর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, তিতিরের হাত থেকে ছোট্টো ছোট্টো পাউরুটির টুকরো গিয়ে পড়ছে নিচের জানলার উপরের কার্নিশে। হুটোপুটি করে খাচ্ছে দুটো কালো, একটা ছিটছিটে আর একটা সাদা পায়রা। ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতি করছে নিজেদের মধ্যে, ভাবগতিক দেখে পষ্ট শুনতে পাই “অমন খোঁচাস কেন মুখপুড়ী!” “সব বড় টুকরো একাই খাচ্ছিস কোন আক্কেলে” মার্কা বকবকম।

পঞ্চমজন কিন্তু ঐখানে আসে না। নিমগাছের ডালে বসে কড়া চোখে সব জরিপ করেন শ্রীমান কাগলা কাগা। তিনি আবার তিতির ঠাকুরানীকে বেশ একটু সন্দিগ্ধ চোখে দেখেন, সে ছাত না ছাড়া অবধি তিনি ভোজনে নামবেন না।

অবশ্য বেচারার দোষও নেই। প্রথম দিন খেয়েদেয়ে ওই নিমগাছের নিভৃতিতেই তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এদিকে তিতির ঠাকুরানীর মনে যে হঠাৎ বইতে লেখা কাক ঝাড়ুদার পক্ষী, এঁটোকাঁটা খায় এসব চাগিয়ে উঠেছে তিনি আর কী করে জানবেন! ঠাকুরানী মায়াপরবশ হয়ে ছাতে জল দেবার পাইপ দিয়ে ‘আহা! নোংরা, চান করতে পায় না” কাগলাকে দিয়েছেন কষে ধুইয়ে! আঁকপাক করে সেই যে উড়াল দিয়েছিলেন, সেই থেকে তিতিরকে ভারি সন্দেহের চোখে দেখেন কাগলাবাবু।

দিকে পাউরুটি শেষ (কাগের ভাগ আলাদা আছে), পিজিনিস্তারা তবু হাঁ করে উপরে চেয়ে আছে। তিতিরও প্রায় একইরকম জুলজুলে চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে দেখে অগত্যা বললুম, যা মুড়ি নিয়ে আয়।

(নোট – বিকেলে মুড়ি আনতে হবে। আধকৌটো তো একদিনে সাবাড় করে দিল!)

মুড়ি ছড়াতে ছড়াতে তিতির উলটো দিকে বাড়ির জানলার কার্নিশের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটা টুথব্রাশ পড়ে আছে। গেছে হয়তো কারও হাত থেকে পড়ে।

“ঐটে পিজিনিস্তাদের বুরুশ, বুঝলে?”

“অ্যাঁ?”

“ঐটেতে পায়রারা দাঁত ব্রাশ করে সকালে, তারপর খেতে আসে। দাদুমণি বলেছে।“

বুঝে নিই। দাদুমণির আজগুবি গল্পের জগৎটা তো আমারও ভারি চেনা! তবু সন্দেহ প্রকাশ করি,

“ভাগ্‌! ওদের দাঁতই তো নেই, দাঁত মাজবে আবার কী!”

ভারি গম্ভীর মুখে চশমাটা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে তিতির বলে,

“দাঁত নেই তো কী! ঠোঁট মাজে। তোমার ঠোঁট ওদের মত শক্ত হলে বুঝতে।“

বলে তিড়িং তিড়িং করে নিচে চলে যায়।

আরেকটু দাঁড়িয়ে ছিলাম আপনমনে, হঠাৎ খেয়াল হল কাগলা ছাতে নেমে এসেছে, তার বরাদ্দ পাউরুটি ঠুকে ঠুকে খাচ্ছে। আমায় দেখেই গলা বাড়িয়ে নিচের দিকে কী যেন দেখাল।

আমি আবার উঁকি মেরে দেখি, পিজিনিস্তা সেই পড়ে থাকা টুথব্রাশে ঘষে ঘষে ঠোঁট মুছছে, আর সবার ছোটো পায়রাটা, হ্যারি, পাশের কার্নিশে ঠোঁট বাগিয়ে বসে আছে...যেন বাথরুম  খালি হলেই ঢুকবে!

বেকুব হয়ে আবার কাগলার দিকেই তাকালুম। সে খেয়েদেয়ে উড়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমার চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন চোখ মটকে বলল, “ক্কঃ!”

সব কেমন গুলিয়ে গেল, বুঝলেন! এবার ঘরে ফিরে গিয়ে যদি দেখি ল্যাপটপটা আড়মোড়া ভেঙে ‘ম্যাও’ বলছে... কিছুই আশ্চর্য হব না!

 

 

Saturday, 2 January 2021

রান্নাবাটি



রান্নাবাটি খেলতে বসেছে মেয়ে। তার কচি হাতের খুন্তি নাড়ার টুংটাং ডেকে এনেছে তার মাকেও।

"অ তিতির? আমায় খেলতে নিবি?"

"হুঁ! তুমি আমার জোগাড়ে হও।"

পূর্বস্মৃতি মাকে বহুল বিচক্ষণ ও সতর্ক করে তুলেছে। তিনি জব ডেস্ক্রিপশন চেক করে নেন, "আমাকেও রান্না করতে দিবি তো? খালি কুটনো কোটা আর বাসন মাজা করাবি না তো?"

কন্যা দয়ার অবতার হয়ে অভয় দেন, হবে হবে, তোমাকেও এক রাউন্ড ব্যাটিং দেওয়া হবে।

মা সুতরাং মাটিতে ধুপ করে বসে পড়েন। ভালো সময়ে জয়েন করা গেছে। রান্নাঘর সাজানো চলছিল। হাতে হাতে লাগিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে বাঁদিকটা পটাপট গুছিয়ে ফেলেন তিনি। 

"ওটা কী হল? ম্যাঁ?"

মেয়ে ছাগলছানার মত ডাক পাড়া মানেই গণ্ডগোল। মা চোখ পাকিয়ে অবলোকন করেন কোথায় কী ছড়িয়েছেন। অ্যাই যাঃ! বালতিটাও ভুল করে গ্লাসের মধ্যে রেখে ফেলেছেন যে র‍্যা! নে বাবা তোর বালতি।

ইকী! হাঁড়ি পাতিলের পাশে প্যাঁচা, ঘন্টা এসব কেন?

"আরে লাগে! তুমি জানো না! ঘন্টা বাজিয়ে খেতে ডাকতে হয়!"

অ, বিলিতি কেতা! তা এসব হাঁড়িকুড়ি খুন্তি সাঁড়াশি  শোভিত রান্নাঘরে রান্না করে তুমি যে ডিনারের গং বাজিয়ে খেতে ডাকবে সে আমি কেমন করে জানব! তাও কিনা ওই ছাগলের গলায় বাঁধা ঘন্টা দিয়ে! 

যাকগে, রাঁধুনির মর্জি। কিন্তু প্যাঁচা কেন বাপু? ঘন্টা শুনেও খেতে না এলে কি প্যাঁচা পাঠিয়ে ঠোকর মারাবি?

"আহ মা! ওটা ডেকোরেশন!"

বুঝলুম। অবশ্য ভেবে দেখলে, অন্ন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর বাহনটিকে ডেকোরেশন হিসাবে রান্নাঘরে সাজিয়ে রাখলে মানানসই হয় বইকি!

তারপর রাঁধুনী রাঁধতে বসল। ও বাবা, সে কী ঘোর রান্না! এই বলে বেগুনভাজা কেটে দাও, এই বলে পিজার উপর চিজ কুরিয়ে দাও! রেঁধেই যাচ্ছে, রেঁধেই যাচ্ছে, মাকে আর চান্স দেয়ই না! মায়ের গালটি ফুলতে ফুলতে যখন ফ্যান উপুড় করা হাঁড়িটার মতো গোল হয়ে এসেছে, তখন দয়াপরবশ হয়ে তিনি সরে বসলেন। 

"তুই তো সবই রেঁধে ফেলেছিস! আমি আর কী রাঁধি বল দিকি! বরং তুই বোস, আমি সাজিয়ে দিই।"

থালা ঘিরে বাটি সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার পর মায়ের  মাথায় কী যে চিড়িং খেলে যায়! আঙুল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে বলতে থাকে, থালায় বেড়ে দিই বুদ্ধি, সাহস, কর্তব্যবোধ, ধৈর্য আর স্বাস্থ্য। এই বাটিতে রইল ঘরের আঙিনা, আর এই বাটিতে রইল ঘুরে বেড়ানোর, দেশ বিদেশ দেখা। এই বাটিতে কাজ করার নেশা, এই বাটিতে নিজেকে নিয়ে সন্তোষ। এই বাটিতে দিলুম স্বপ্ন দেখার মন, আর এইটিতে লড়াই করার জেদ। আর এই গ্লাসে কানায় কানায় ভর্তি করে ঢেলে দিলুম আপনজনার আদর। 

মেয়ে অবাক চোখে দেখে মায়ের কাণ্ড। দেখতে দেখতে মায়ের কোলে ঠেলে উঠে বসে, চুপটি করে কী যেন ভাবে। তাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে মা কানে কানে শেষ কথাটি বলে দেয়,  রান্নায় নুনের মত, এই সবেতেই ভালোবাসাটি মিশিয়ে দিতে ভুলিস না যেন কখনো! দেখবি, জীবন কত স্বাদের, কত তৃপ্তির!