রান্নাবাটি খেলতে বসেছে মেয়ে। তার কচি হাতের খুন্তি নাড়ার টুংটাং ডেকে এনেছে তার মাকেও।
"অ তিতির? আমায় খেলতে নিবি?"
"হুঁ! তুমি আমার জোগাড়ে হও।"
পূর্বস্মৃতি মাকে বহুল বিচক্ষণ ও সতর্ক করে তুলেছে। তিনি জব ডেস্ক্রিপশন চেক করে নেন, "আমাকেও রান্না করতে দিবি তো? খালি কুটনো কোটা আর বাসন মাজা করাবি না তো?"
কন্যা দয়ার অবতার হয়ে অভয় দেন, হবে হবে, তোমাকেও এক রাউন্ড ব্যাটিং দেওয়া হবে।
মা সুতরাং মাটিতে ধুপ করে বসে পড়েন। ভালো সময়ে জয়েন করা গেছে। রান্নাঘর সাজানো চলছিল। হাতে হাতে লাগিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে বাঁদিকটা পটাপট গুছিয়ে ফেলেন তিনি।
"ওটা কী হল? ম্যাঁ?"
মেয়ে ছাগলছানার মত ডাক পাড়া মানেই গণ্ডগোল। মা চোখ পাকিয়ে অবলোকন করেন কোথায় কী ছড়িয়েছেন। অ্যাই যাঃ! বালতিটাও ভুল করে গ্লাসের মধ্যে রেখে ফেলেছেন যে র্যা! নে বাবা তোর বালতি।
ইকী! হাঁড়ি পাতিলের পাশে প্যাঁচা, ঘন্টা এসব কেন?
"আরে লাগে! তুমি জানো না! ঘন্টা বাজিয়ে খেতে ডাকতে হয়!"
অ, বিলিতি কেতা! তা এসব হাঁড়িকুড়ি খুন্তি সাঁড়াশি শোভিত রান্নাঘরে রান্না করে তুমি যে ডিনারের গং বাজিয়ে খেতে ডাকবে সে আমি কেমন করে জানব! তাও কিনা ওই ছাগলের গলায় বাঁধা ঘন্টা দিয়ে!
যাকগে, রাঁধুনির মর্জি। কিন্তু প্যাঁচা কেন বাপু? ঘন্টা শুনেও খেতে না এলে কি প্যাঁচা পাঠিয়ে ঠোকর মারাবি?
"আহ মা! ওটা ডেকোরেশন!"
বুঝলুম। অবশ্য ভেবে দেখলে, অন্ন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর বাহনটিকে ডেকোরেশন হিসাবে রান্নাঘরে সাজিয়ে রাখলে মানানসই হয় বইকি!
তারপর রাঁধুনী রাঁধতে বসল। ও বাবা, সে কী ঘোর রান্না! এই বলে বেগুনভাজা কেটে দাও, এই বলে পিজার উপর চিজ কুরিয়ে দাও! রেঁধেই যাচ্ছে, রেঁধেই যাচ্ছে, মাকে আর চান্স দেয়ই না! মায়ের গালটি ফুলতে ফুলতে যখন ফ্যান উপুড় করা হাঁড়িটার মতো গোল হয়ে এসেছে, তখন দয়াপরবশ হয়ে তিনি সরে বসলেন।
"তুই তো সবই রেঁধে ফেলেছিস! আমি আর কী রাঁধি বল দিকি! বরং তুই বোস, আমি সাজিয়ে দিই।"
থালা ঘিরে বাটি সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার পর মায়ের মাথায় কী যে চিড়িং খেলে যায়! আঙুল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে বলতে থাকে, থালায় বেড়ে দিই বুদ্ধি, সাহস, কর্তব্যবোধ, ধৈর্য আর স্বাস্থ্য। এই বাটিতে রইল ঘরের আঙিনা, আর এই বাটিতে রইল ঘুরে বেড়ানোর, দেশ বিদেশ দেখা। এই বাটিতে কাজ করার নেশা, এই বাটিতে নিজেকে নিয়ে সন্তোষ। এই বাটিতে দিলুম স্বপ্ন দেখার মন, আর এইটিতে লড়াই করার জেদ। আর এই গ্লাসে কানায় কানায় ভর্তি করে ঢেলে দিলুম আপনজনার আদর।
মেয়ে অবাক চোখে দেখে মায়ের কাণ্ড। দেখতে দেখতে মায়ের কোলে ঠেলে উঠে বসে, চুপটি করে কী যেন ভাবে। তাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে মা কানে কানে শেষ কথাটি বলে দেয়, রান্নায় নুনের মত, এই সবেতেই ভালোবাসাটি মিশিয়ে দিতে ভুলিস না যেন কখনো! দেখবি, জীবন কত স্বাদের, কত তৃপ্তির!
No comments:
Post a Comment