Sunday 30 October 2016

বাঁদোর


তিতির না, বাঁদর ওড়াতে ভারি ভালবাসে।

আরে না না আমার মাথা খারাপ হয়নি। বোম্বেতে সত্যিই বাঁদর ওড়ানো হয়। বেলুন দিয়ে তৈরি বাঁদর। জুহু বিচে হু হু করে হাওয়া দেয় তো, ঐ বাঁদরের সঙ্গে লম্বা সুতো দেয়, ঠিক ঘুড়ি ওড়ানোর মত করে লোকে ওড়ায়।

ওগুলো বানায়ও খাসা। গোল বেলুনের মাঝে বেঁধে মাথা ও পেট, লম্বাটে বেলুন দিয়ে হাত আর পা, একটা সরু লম্বা পাকানো গোছের বেলুনের ল্যাজ। এহেন বাঁদর যে তিতিরের পছন্দ হবে সেটা বলাই বাহুল্য। তার ওপর উড়ন্ত বাঁদর। তিতিরের চেয়েও, তার দাদুমণির বেশি পছন্দ দেখি। ছোট্টবেলার ঘুড়ি লাটাই নিয়ে ছাতে ভোকাট্টা করার স্মৃতি ফিরে আসে মনে হয়। তাই সময় সুযোগ হলেই পল্টন নিয়ে জুহু যাবার চেষ্টা করি। কিন্তু ইদানীং সেটা আর হচ্ছে না, অফিসে কাজের চাপে ফেঁসে চিপিটক-মূর্তি ধারণ করিতেছি কিছুকাল ধরে, সময় বার করতেই পারছি না।

কিন্তু পুঁচকি মেয়ের কি বেড়াতে না গেলে ভাল্লাগে, না আমারই ভাল্লাগে ওকে নিয়ে যেতে না পারলে! কাজেই জুহু যখন হচ্ছে না তখন জিজাই সই! মানে রাজমাতা জিজাবাই উদ্যান, অর্থাৎ রানীবাগ, অর্থাৎ বাইকুল্লা জু - বোম্বের একমাত্তর চিড়িয়াখানা।

কলকাতার চিড়িয়াখানা গিয়ে যারা অভ্যস্ত তারা অবশ্য নাক সিঁটকোবে। বলতে গেলে কিছুই প্রায় নেই জন্তু জানোয়ার। কয়েকটা হাতি হরিণ বাঁদর (না উড়ন্ত নয়) জলহস্তী কুমীর নীলগাই নেকড়ে আর কিছুকিঞ্চিৎ পক্ষীকূল চিড়িয়াখানার নাম রোশন করার ঝিমন্ত চেষ্টা করে। এক ঘন্টার বেশি লাগে না ঘুরতে।

কিন্তু কপালগুণে আমার মেয়ে মায়ের সাথে বেই-বেই বড় ভালবাসে। সে সামান্য একটা দোলনাওলা পার্কে নিয়ে গেলেও ভারি খুশি হয়। আরেকটা সুবিধে হল ভারি কাছে, টুক করে আধ ঘন্টায় পৌঁছনো যায়। সুতরাং রোববার জলখাবার খেতে খেতেই ঠিক করলুম আপাতত রাজমাতাকেই দর্শন করে আসি।

সেজেগুজে বেরোতে যা দেরি। তিতিরের প্রশ্নাবলী শুরু হয়ে গেল।
আমারও মন ফুরফুরে, তাই উত্তর দিতে কার্পণ্য নেই।

'মা আমরা জু যাচ্ছি, না?'
'
হ্যাঁ মা। জু যাচ্ছি তো।'

'মা আর কদ্দূর?'
'
আরে এই তো শুরু করলুম। একটু সময় লাগবে দাঁড়া।'

'মা জুতে হাতিগুলোর আমাকে মনে আছে?'
'
হ্যাঁ! ওরা তো রোজ বলে তিতির কবে আসবে, এখনো আসছেনা কেন।'
(
আহ্লাদে তিতির এক গাল হেসে ফেলে।)

'মা আর কদ্দূর?'
'
আরো খানিকটা মা।'

'মা আমি কিন্তু খেলাও কব্বো, আমায় খেলা করতে দেবে তো?'
'
বেশ তো, করিস। স্লিপ দোলনা কিসব আছে তো চ দেখি।'

'কি মজা না, আমরা জু যাচ্ছি?'
'
হ্যাঁ মা।'
(
মা এবার একটু পরিশ্রান্ত)

'মা আর কদ্দূর?'
'
আর একটু সোনা।'

'কুমীর আমায় খেতে আসবে না তো?'
'
না না অমন দুষ্টুমি করলে আমি কুমীরের কান মলে দেব।'

তিতিরের গম্ভীর মুখে আপত্তি,
'
কি করে মলবে? কুমীরের মোটেই কান নেই, কানের ফুটো আছে। আমি ছবি দেখেছি।'
বিব্রত মা মেকাপ দিতে চেষ্টা করে,
'
আহ হ্যাঁ ওই কানের ফুটোয় চাঁটি মারব।'

'মা আর কদ্দূর?'
'
এইবার এসে গেছি, আর একটু রে।'

'মা আর কদ্দূর?'
'
চুপ করে বোস না আর তো একটুখানি।'

'মা আর কদ্দূর?'
শুনতে পাইনি ভাব করে জানলা দেখতে থাকি, আহা কি নীল আকাশ মৃদু সমীরণ ছ্যাঁকছ্যাঁক রোদ উড়ু উড়ু মন...
ধৈর্যর মহতী পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে চিড়িয়াখানার গেটে নামি অবশেষে। ছোট্ট মানুষের হাত ধরে গটগট করে ঢুকে পড়ি। পরক্ষণেই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিই।

লেঃ! একেই কিছু নেই, তায় আবার চারদিকে খুঁড়ে টুঁড়ে একাকার করে রেখেছে। কি বানাইতেছ হে হরিপদভাই?
হরিপদ না, জাকিরভাই। সব সারাই হচ্ছে। ঝকঝকে নতুন হবে। জনরব নাকি পেঙ্গুইনও আসবে!

বেশ বেশ। আপগ্রেড হচ্ছে দেখে পরম পুলকিত হয়ে পক্ষীঘরের দিকে হাঁটা দিই। ও তিতির, কাকাতুয়া না, ওটা ম্যাকাও। এইদিকে কাকাতুয়া দেখ। আর এদিকে পিছন দিকে ধনেশ পাখি তার ঠোঁট সামলে বসে আছে দেখেছিস? আর এই খাঁচাটায় ব্ল্যাক আইবিস আর পেইন্টেড স্টর্ক, মনে আছে দিম্মা চিনিয়ে দিয়েছিল?

পাখপাখালি দেখে আর কিছু খুঁজে পাইনা। যে খাঁচায়ই উঁকি দিই, সেটাই খালি। এমনকি এঁকেবেঁকে যাওয়া খালটাও। রেগেমেগে খেলার জায়গাটায় চলে গেলুম দুজনে। সেটা পেয়ে অবশ্য তিতিরের আহ্লাদ আর ধরে না। নেচেকুঁদে চড়ে দুলে ঘুরপাক খেয়ে হেসে লাফিয়ে তার দিলখুশ, আম্মো খুশ।

তারপর যে দুটো অবধারিত থাকে, সেই কুমীর আর হাতি দেখিয়ে নিই।
কুমীর জলে পেট ডুবিয়ে শুয়ে ঘুমঘুম করছে, আর হাতিরা তেড়েফুঁড়ে কান আর ল্যাজ নাড়ছে।
তিতিরের তাই দেখেই মহানন্দ। যাই বল বাপু, ভারি তৃপ্তি হয় ঐ হাসিটা দেখলে।

তারপর মা-মেয়ে হাত ধরাধরি করে দোলাতে দোলাতে, পপ কর্ণ কিনে, ভোঁ করে বাড়ি ফিরে আসি। এসে স্নান করার আগে তেল মাখতে মাখতে তিতিরের হঠাৎ খেয়াল হল, 'বাঁদর দেখলুম না তো!'

ভাবলুম বলি দিবারাত্রি রাস্তায় বেরোলেই দেখিস তো, এই জঙ্গল ভরা কলোনিতে তারা সদলবলে বিরাজ করে। যত পায়রা, তত কাঠবিড়ালি আর ততই লালমুখো বাঁদর।

তার আগেই, কন্যা বললেন, 'এই দ্যাকো আমি কি সুন্দর বাঁদোর হইচি!'

আমি মুগ্ধ চোখে তেলচুকচুকে গায়, দু হাঁটু অল্প ভেঙ্গে, দু হাত কুস্তিগীরের পোজে তুলে গাল ফুলিয়ে দাঁড়ানো মেয়ের খুশিমুখ দেখি। নাহ, পরের রোববার এই মিষ্টি বাঁদরটাকে বাঁদর ওড়াতে জুহু নিয়ে যেতেই হবে দেখছি!

1 comment: