ফ্যান্সি ড্রেস নিয়ে প্রতি বছর কি যে ফ্যাসাদে
পড়ি সে আর কহতব্য নয়। আরে ঐ যে বচ্ছর বচ্ছর ইশকুলে হয় গো? যাতে সারি সারি গলায়
স্টেথো মিনি-ডাক্তার, টপ হ্যাট ম্যাজিশিয়ান থেকে শুরু করে গাউন নিয়ে লটপট করা
ব্যক্তিত্বময় বিবেকানন্দ, ক্ষীণতনু চার্লি চ্যাপলিন থেকে আরম্ভ করে নাদুশনুদুশ
কেষ্টঠাকুর, আর মেয়েমহলে পিঠে ডানা হাতে জাদুদন্ড পরী, নাকে নথ বালিকা বধূ থেকে
আদি নীল-সাদা শাড়ির হকদার মাদার টেরিজা অবধি ঘুরে বেড়ায়, স্টেজে উঠে ভাষণ দেয়। তবে সুখের কথা তিতির কিনা
এখনো বাচ্চা, ওদের শুধু স্টেজে উঠে একটা পোজ দিয়ে দাঁড়ালেই চলে, কিছু বক্তব্য পেশ
করতে হয় না।
কিন্তু পোজ দিতে হলেও তো কিছু একটা সাজতে
হবে? ধরে নাও আমি একটা জিবেগজা, কি ইলেকট্রন, কি মিসিং লিংক – বলে দাঁড়িয়ে পড়লেই
যদি ল্যাঠা চুকে যেত! আচ্ছা কেন যায় না বলুন তো, আমি তো দিব্যি ‘এই মনে কর আমি
একটা গাছ’ বলে হাত টাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি, আর তিতিরও দিব্যি ‘আর আমি একটা কুইরেল’
বলে তর তর করে ভুঁড়ি বেয়ে কোলে উঠে পড়ে। কিংবা তিতির বলে ‘মনে কর আমি একটা
চিতাবাঘ’, আমিও অমনি দেখতে পাই গায় চাকা চাকা দাগওলা এক অতি বিচ্ছু ছানা-চিতা,
রাজকীয় চালে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে, ল্যাজের ডগাটা একটু একটু নড়ছে, এমনকি
বেঘো গন্ধটাও নাকে পেয়ে যাই। কিন্তু তিতিরের ক্লাসের ছানাপোনাগুলো যদি বা এসব
দেখতে পারে, তাদের বাবা মা বা টীচাররা দেখতে পাবেন আশা করা বাতুলতা।
অগত্যা মেয়েকে বেশ একটা খোলতাই দ্রষ্টব্য কিছু রূপ
ধারণ করাতে হবে – মানে ভেবেচিন্তে চরিত্র চিত্রায়ন থেকে নাট্যরূপ প্রদান, মায়
ফার্স্ট (ও একমাত্র)এডিশন পাবলিশ করা অবধি সব আমার আর তিতিরের দিম্মার হোমটাস্ক! দু
সপ্তাহ ধরে দুজনে প্রাণ ভরে মস্তক ঘর্মাক্ত করতে লাগলুম, আর তিতির প্রতিদিন নতুন
নতুন দাবি করতে লাগল। তার অনেকগুলোই খারাপ না, কিন্তু ঐ যে আমার মাথায় ক্যারাপোকা
এবং বাজারে কিঞ্চিৎ ক্রিয়েটিভ বদনাম আছে, যেটা সম্বন্ধে আবার কোন পাপের ফলে কে জানে
তিতিরের টীচার মহলও ওয়াকিবহাল, ফলে চেনাজানা ‘প্রজাপতি’ (খুব সহজ বানানো, রেডিমেড ডানা,
অ্যান্টেনা সব আছে), ‘ফেয়ারি প্রিন্সেস’ (ওই ডানা দিয়েই চলবে, আর জুহু থেকে কেনা
পেন্সিলের মাথায় স্টার, আর কাগজ কেটে মুকুট) বা ‘রাধা’ কি ‘মীরাবাই’ (সেম ঘাগরা মেকাপ
আর কান্নিক মেরে চুল বাঁধা, খালি একটু গয়নাগাটির রকমফের ব্যাস!) করতে তো মন চাইছে
না!
ফলে কিছুদিন এই চলল -
“ক্যাটারপিলার! মা আমি ক্যাটারপিলার হব!”
সবুজ চার্টপেপার কিনতে হবে তাহলে, গোল গোল কেটে
বডি, কালোও লাগবে, পা আর শিং বানাতে হবে, কিন্তু পিছনে বোর্ড না দিলে কি শক্তপোক্ত
হবে? আর ক্যাটারপিলার স্টেজে কি পোজ দেবে? চাট্টী ফুলকপির পাতা ধরিয়ে দেব নাকি
হাতে?
ভাগ্যিস কিনে ফেলিনি। পরদিনই মেয়ের মন পালটে
গেল।
“আমি ডাক হব মা! ইয়েলো ডাক! প্যাঁক প্যাঁক করে
ডাকব স্টেজে উঠে।”
মানে হলুদ চার্টপেপার। চলবে। অরেঞ্জ লেগিংস পরা
পা। কমলা ঠোঁট – কেলেংকারি করেছে! ওরকম থ্যাবড়াপানা হংসচঞ্চু বানাইব ক্যাম্নে? ঘোর
দুশ্চিন্তায় জল খেতে গিয়ে ভুল করে কাফ সিরাপ খেয়ে ফেলি।
“আর ল্যাজ করে দেবে, ল্যাজ নাড়ব বেশ স্টেজে
উঠে!”
এবার থপাস করে এমন জোরে বসে পড়ি যে নিজের
ল্যাজে, আহ নেই, মানে থাকলে যেখানটায় থাকত সেখানে ব্যথা লেগে যায়।
নাড়ানোর যোগ্য ল্যাজ বানাতে হবে? হাঁস সাজতে
গিয়ে আমায় হাঁসফাঁস করিয়ে দিচ্ছিস তো!
পরদিন সেটাও পালটে যায় আবার। তিনি স্বপ্নে জিরাফ
দেখেছেন। অতএব এবার জিরাফত্বের দাবি।
এককথায় নাকচ করে দিই। অত লম্বা গলা খালি চার্ট
পেপারের কম্মো নয়। আর অফিসের পর ঘুরে ঘুরে অত বড় থার্মোকল জোগাড় করে এনে তাতে
জিরাফ কাটা, পড়তায় পোষাবে না। আর সেই এক সমস্যা, স্টেজে উঠে কি বা পোজ দেবে? তার
চেয়ে হাতি হ!
“এলি! এলি দ্য এলিফ্যান্ট!”
ছাই রঙের চার্ট পেপার কি হয়? না হলে সাদা এনে রং
করতে হবে। দুটো ধ্যাবড়া কান, শুন্ড, ও হো সাদা তো লাগবেই দাঁত করতে হবে, ওরকম ছাই
ছাই রঙের লেগিংস আছে মনে হচ্ছে, ব্ল্যাক শু। একটা পুঁচকে কলাগাছ পাওয়া যায় কিনা
খুঁজব চেম্বুরের বাজারে?
পরদিন আবার মন খুঁতখুঁত করে। ঠিক তেমনটা হচ্ছে
না।
আচ্ছা, তোর ইশকুল কি চিড়িয়াখানা নাকি? খালি জীবজন্তু
সাজতে চাইছিস কেন?
তিতির আর কিছু ভেবে না পেয়ে বোধহয় গাছ হতে চাইল
এবার।
এটা কিন্তু আমাদেরও মনে ধরল। বেশ দুহাত ছড়িয়ে
দাঁড়াবে, সারা গায় ব্রাউন পেপার জড়িয়ে দেব। সবুজ চার্ট পেপার কেটে পাতা করে ডালে
আটকে দেব, ফুল-ফলও লাগিয়ে দেব কিছু, আর ছোট পুতুল মাংকিটা ঝুলিয়ে দেব এক হাতে। মাথায়
একটা ঝাঁকড়া পাতা-ফাতাওলা হেডব্যান্ড, তার মধ্যে একটা পাখির বাসা বসিয়ে দেব নাহয়,
ঐ ম্যাকাও পুতুলটা আর গোটা দুই ছোট বলকে ডিম করে...
“সত্যিকারের ডিম দেবে! আন্ডা!”
“আরে! পড়ে গেলে ফেটে যাবে, সব চটচট হবে!”
“না সত্যিকারের ডিম দিতে হবে। ম্যাকাওটা বেশ তা
দেবে!”
কদিন এটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলল। তারপর এক ঘনঘোর
সন্ধ্যায় তিতিরের দিম্মার ব্রেনওয়েভ।
সরস্বতী পুজোয় পরবে বলে কেনা লাল-পাড় উজ্জ্বল
হলুদ শাড়ি আছে।
তিতিরের মাথায় লম্বা চুল আছে।
এক কাঁড়ি হার-বালা-টিপ ইত্যাদি আছে।
ছ মাস আগে নতুন ওয়াশিং মেশিন কেনার দরুণ একটা
জম্পেশ চৌকো শেপের থার্মোকল আছে।
শাড়িটি পেঁচিয়ে, চুড়োখোঁপা বেঁধে, মালা টালা
পরিয়ে, আর ঐ থার্মোকলে ভারতের ম্যাপ সেঁটে দড়ি দিয়ে পিঠে বেঁধে দিলেই
“ভারতমাতা”!
যুগোপযোগী রূপ? আরে দূর, আমাদের বঙ্কিম অরবিন্দ
রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা, আদি, আবহমান, চিরন্তন।
সবাই মিলে এটা ফাইনাল হয়ে গেল। কাজেই আর না ভেবে
কাজে লেগে গেলুম। পরদিনই ফিরতি পথে নীল, কমলা, গাঢ় সবুজ, কলাপাতা সবুজ, আর হলুদ সব
রকম চার্ট পেপার নিয়ে এলুম। অত বড় ম্যাপ কোন একটা পেপারে হবে না, আর জোড়াই যখন দেব
তখন একটু রং নিয়ে নিই! টুলে চড়ে, কোন অঘটন না ঘটিয়ে থার্মোকলটিও প্রত্যন্ত মাচা
থেকে আহরণ করে ফেললুম।
পরের দিনটা গেল তাতে মাপসই চারটে ফুটো করতে যাতে
তিতিরের পিঠে ওটা বাঁধা যায়। বেঁধে দেখে নিতে হল আন্দাজ করার জন্য, আর তার ফলে
আরেকটু হলেই সব প্ল্যান ভোগে যাচ্ছিল, কারণ তিতির ওটা পিঠে বাঁধা অবস্থাতেই খেলার
ঘরে যেতে গিয়ে দরজায় আটকে গেছিল। আমি পৌঁছনোর আগে আরেকটু টানাটানি করলেই দুর্বল
থার্মোকল দেহরক্ষা করত। উদ্ধারপর্ব সেরে, তাতে আগাপাশতলা আকাশ নীল পেপার সেঁটেও
ফেললুম। একদিনের পক্ষে যথেষ্ট!
তিতির কাউকে বলবি না কিন্তু কি সাজছিস!
সারপ্রাইজ, হ্যাঁ?
অতএব, পরদিনই তিতিরের সারা ক্লাস, এবং বাড়ির সব
বন্ধু জেনে গেল ‘ভারতমাতা’ কারে কয়! সবাইকেই গুছিয়ে বারণ করে হয়েছে অবশ্য কাউকে যেন না বলে, কারণ
এটা ‘সারপ্রাইজ’!
---
শনিবার ফ্যান্সি ড্রেস কম্পিটিশন। বিষ্যুদবার
রাত অবধি কাজ আর বিশেষ এগোল না। শুক্রবার আধবেলা ছুটি নিলুম শেষে। একটু ফাঁকিবাজির
চেষ্টা করলুম, দোকান থেকে বড় সাইজের ভারতের ম্যাপ কিনে আনতে গেলুম। কিন্তু পেলুম
না, নেই। যাকগে যাক, বয়েসকালে রাখীদির তত্ত্বাবধানে কয়েকশোবার ভারতের ম্যাপ
এঁকেছি, এটাও এঁকে দেব। বাইরের ঘরে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসা গেল, চার্ট পেপার, ফেভিকল, কাঁচি,
পেন্সিল রবার সব নিয়ে, রেফারেন্স হিসেবে ট্যাবে ভারতের ম্যাপ খুলে। কমলায় উত্তর
ভারত, হলুদে পশ্চিম, কলাপাতা সবুজে পূর্ব আর গাঢ় সবুজে দক্ষিণ ভারত। উত্তরটা অনেক
কসরত করে এঁকে মুখ তুলে দেখি তিতির ট্যাব নিয়ে পগারপার।
তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে পাশে বসিয়ে, ম্যাপ খুলে
আবার আঁকতে বসলুম। ওরে চা দিচ্ছিস না কেন? পিঠে ব্যথা হয়ে গেল যে!
আমাদের কচিবেলায় প্যাকম্যান বলে একটা গেম ছিল
মনে আছে? আজকের ভিডিও গেমস এর পূর্বজ? সেই একটা আধখানা মুখ কপ কপ করে গুল্লি খেতে
খেতে যেত? গুজরাট আঁকতে গেলেই আমার সেটার কথা মনে পড়ে যায় – কেমন একটা হাঁ মুখের
মত না? খুব যত্ন করে সেই হাঁয়ের খাঁজগুলো আঁকছি, মাতৃদেবীর মন্তব্য, খুব তো
কারুকার্য করছ, ঐ সঘন কম্পমান রেখা বরাবর যে কাটতে হবে সে খেয়াল কি আছে?
শুনেই তো আমি নেই! অ্যাঁ, আবার কাটতেও হবে?
সে তো হবেই! নইলে অত কষ্ট করে নীল কাগজ মারলি
কেন ঢ্যাঁড়শ? সমুদ্দুর বোঝাবি বলে না?
তাই তো! তেমনই তো ভেবেছিলুম বটে। নাগাড়ে এতক্ষণ
উপুড় হয়ে ম্যাপ আঁকতে গিয়ে সে তো ভুলেই মেরে দিয়েছি। আচ্ছা দেখা যাক কদ্দূর কি
পারি। আগে দেখ তো চারটে অংশ সমঞ্জস হল কিনা।
তিতির দেখে বলল “কি সুন্দরী হয়েছে মাম্মা!”
মা দেখে বলল ডানদিক উঠে আর বাঁদিক নেমে গেছে।
সে তো আমার মাগো, এঁকে এঁকে ডান কাঁধ টনটন আর ভর
দিয়ে বসে থেকে থেকে বাঁ কাঁধ অসাড় হয়ে গেছে!
কিন্তু ম্যাডামজী ঠিকই বলেছেন, উঠে দাঁড়িয়ে দেখি
ত্যাড়াব্যাঁকা হয়ে গেছে ব্যাপারটা। এত বড় স্কেলে আগে তো আঁকিনি। আবার রবার পেন্সিল
নিয়ে লেগে পড়ি।
উফফ কি খাটনি! হ্যাঁ রে, আইডিয়া! তুই
‘স্কুলগার্ল’ সেজে যা না?
দিম্মা আর নান্নির যৌথ দৃষ্টিক্ষেপে প্রায় ভস্ম
হয়ে গেলুম। কিন্তু আরেক কাপ চা না দিলে মাইরি পারছি না যে! আর তোমরা বাপু নিচে
খেলতে যাও, তিতির এরকম চারদিকে ধেই ধেই করে নেচে বেড়ালে আর মিনিটে মিনিটে কানের
কাছে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ফেললে মন দিতে পারছি না তো!
---
রাত নটা। তিতির খেতে বসেছে। ম্যাপ আঁকা শেষ, চার
টুকরো জুড়ে আটকানো হয়ে গেছে, থার্মোকলের ফুটো দিয়ে জরির ফিতে পরিয়ে রাখা আছে,
স্টেজে ওঠার আগে বেঁধে দিলেই হবে। দিম্মা বিকেলে বেরিয়ে ঘুড়ির কাগজের মত পাতলা
ফিনফিনে কাগজ কিনে এনেছেন, এখন সেগুলো কায়দা করে কুঁচি বানিয়ে তাই দিয়ে হাতের গলার
খোঁপার মালা গাঁথছেন। আমি এখনো ভূমিতলে, এবার ভারতমাতার হাতের ঝান্ডা বানাচ্ছি। সাইজমত
লাঠি খুঁজে পাইনি, একবার ভাবছি আলমারির সাইডের একটা রড খোলা যায় কিনা, একবার ভাবছি
মপার এর ডান্ডাটা খুলে নিলে কি মা চেঁচাবে, একবার ভাবছি তিতিরের ভাঙ্গা ছাতার
ডাঁটিটা কি চলবে, করতে করতে মনে পড়ল একগাদা ইলেকট্রিক লাইনের কভারের টুকরো পড়ে
আছে, তার একটা মাপমত এনে কাগজ পেঁচিয়ে দিলেই হবে। আরো একটা টাস্ক লিস্টে জুড়ল তার
মানে।
রাত সাড়ে দশটা। ম্যাপ – চেক। ফ্ল্যাগ – চেক। বেশ
পাকাপোক্ত পতাকা হয়েছে – ঐ যাঃ, অশোকচক্র আঁকতে ভুলে গেছি যে! থাক, কাল সকালে হবে,
এখন আঁকলে সে চক্র বড়ই বক্র হবে। কাগজের মালাসমূহ – চেক। এক্সট্রা ব্যাকাপ
গয়নাগাঁটি - চেক (যা শান্ত মেয়ে, যদি কাগজ ছিঁড়ে ফ্যালে স্টেজে ওঠার আগেই?)। শাড়ি – চেক। আর যা যা লাগতে পারে – চেক। চ চ শুতে চ
এবার।
----
পরদিন ব্রাশ করেই আগে অশোকচক্র প্রদান করি, মানে
পতাকাকে আর কি। তারপর ভারতমাতা নির্মাণ পর্ব। শাড়ি পরা সাজুগুজু সব কিন্তু সুন্দর
চটপট হয়ে গেল, খালি মাঝে একবার ভারতমাতা আত্মবিস্মৃত হয়ে খাটে উঠে ধেই ধেই করে
লাফাচ্ছিলেন আর শাড়ি গোঁজার সময় তাঁর খুব কাতুকুতু লাগছিল বলে তিনি গোঁসা হয়েছিলেন
দু মিনিটের জন্য।
তারপর আমরা শোভাযাত্রা করে রওনা
দিই। সবার আগে ‘ভারতমাতার অঙ্গসজ্জায়’ দিম্মা, তার কাঁধের ব্যাগে ব্যাকাপ
গয়নাগাঁটি আর হাতে একটা প্লাস্টিকে খুব সন্তর্পণে নেওয়া কাগজের মালাগুলো। তার
পিছনে একহাতে পতাকাটি উঁচু করে ধরে আর অন্য হাতে খাবার জলের বোতল নিয়ে
‘ফ্ল্যাগ-গার্ল’ বন্দনা। তার পিছনে স্বয়ং ভারতমাতা, সুহাসিনী, সুভাষিনী – মানে খিল
খিল করে হাসছে আর অনর্গল বকবক করছে। আর সবার শেষে ‘দেশের ধারক ও বাহক’ আমি, হাতে ঐ
গোবদা ম্যাপ। রাস্তা দিয়ে যেই যাচ্ছে চেনা হোক বা অচেনা, বেশ একগাল হেসে
দিচ্ছে। দেখে মনে পড়ল, গত বছরও এই ফ্যান্সি ড্রেস হয়েছিল। তিতির সেবার সেজেছিল
পাকানো গোঁফ ওলা, মাথায় পাগড়ি, পিঠে তীর ধনুক, হাতে তরোয়াল “বীরপুরুষ”। হ্যাঁ মশাই,
ওর প্রিয় কবিতা যে! তো সেবার এত মালপত্তর ছিল না, আমি একাই ওর হাত ধরে যাচ্ছিলুম।
পথে এক বয়স্কা মহিলা, স্থানীয় ঢঙ্গে কাপড় পরা, ওকে দেখে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়ে
পড়লেন। তারপর ‘জয় রামজী’ বলে এক বিশাল নমস্কার!
এবারে অবশ্য সেরকম কিছু হল না। স্কুলে
গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়াতে হল, বন্দনার সাথে ম্যাপ আর ফ্ল্যাগ পালটাপালটি করলুম –
গোটা ভারতবর্ষের ভার আর কতক্ষণ একা বওয়া যায়, বলুন? আরো সব ছেলেমেয়েরা আসছে – ভুল
বললুম। আজ ছেলেমেয়ে না। আজ আসছে মৌমাছি, প্রজাপতি, লুডোর ছক্কা, ম্যাজিশিয়ান,
প্রজাপতি, রামচন্দরজী, সেলফোন, কৃষ্ণ, রকেট, আবার প্রজাপতি, আবার কৃষ্ণ, মাদার
টেরিজা (কি বলেছিলুম? থাকবেই), পুলিশ, আবার আবার প্রজাপতি, নিনজা, আবার আরেকটা রকেট,
এটা কি – খনিশ্রমিক বোধ হয় – ও না, কৃষক, বার্বি ডল, ঝাঁসীর রানি, জলদস্যু – বা
বেশ তো, স্পঞ্জবব, গাজর, কাশ্মিরী কন্যা, বোঝো! নরেন্দ্র মোদী! প্রিন্সেস, পোস্ট
বক্স, এ আবার কে? কিউপিড – অ্যাঁ, পাঁচ বছরের ছানা কিউপিড মানে বোঝে? ডাক্তার,
মারাঠী ভাউ। যাহ! এ বছর একটাও হনুমান নেই? গত বছর গোটা দুই ছিল, সেই সাথে এক
নগ্নদেহ পল্লবমেখলা-আবৃত আফ্রিকান ট্রাইব-বালক।
যাই হোক এরা ভিতর যায়। আমরা সারি
বেঁধে হলে গিয়ে বসি। তারপর এরা আবার লাইন করে এসে এক পাশে দাঁড়ায়। অমনি আমরা সবাই
হুড়োহুড়ি করে উঠে গিয়ে যার যার ছানাটাকে ফিনিশিং টাচ দিয়ে দিই। দিম্মা মালাগুলো
ঠিকঠাক করে দেয়, আমি আর বন্দনা মিলে ভারতবর্ষকে যথাস্থানে বেঁধে ফেলি। তিতির
অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে যায় তারপর, ম্যাপে কেউ যেন ‘টাচ না করে!’ হবি তো হ তার পিছনে
দাঁড়িয়েছে কৃষক বালক - সে সমানে ‘চল কোদাল চালাই’ করছে। তিতিরের নির্বন্ধাতিশয্যে
তাকে আবার একটু বাবা-বাছা করে বলে দিই সে যেন এই ভারতবর্ষের মাটিতে চাষ করতে না
লেগে যায়।
বসে বসে দেখতে কিন্তু ভারি ভাল
লাগে যাই বলুন। কৃষ্ণ লাল-কালো কাবলি চপ্পল পরত, জানতেন? নরেন্দ্র মোদীর দাড়িটা
বোধহয় টুথপেস্ট দিয়ে বানিয়েছে, গরমে ঘামে গলে গলে গেছে। ঝাঁসির রানি বেশ স্মার্ট
তো, কি সুন্দর পিঠে পুতুল বেঁধে, তরোয়াল বাগিয়ে বেঁকে দাঁড়াল! এই যাহ, রকেটের
তিনকোণা টুপি খুলে পড়ে গেছে, টিচার পরিয়ে দিতে আবারো খুলে পড়ে গেল – থাক থাক, এ
রকেট ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস। রুবিক কিউব নিজেই চারপাক ঘুরে গেল স্টেজে। সব মিলিয়ে
হাসির ফোয়ারা। ভারতমাতা হাসিমুখে ফ্ল্যাগ ধরে দাঁড়িয়েছেন, ভাল হাততালিও পেয়েছেন।
শেষ
হবার পর আরেকটু ইনফর্মাল ছবি তোলা টোলা হয়। তিতিরের পিঠ থেকে ম্যাপটা খুলে নিয়েছি,
সে রামচন্দ্র আর নিনজার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। ঝাঁসির রানী আর মীরাবাই পাশাপাশি
দাঁড়িয়ে আছে দেখে শখ হল তিনকন্যার একটা ছবি তুলি। তা তাদের তখন খেলার মুড – তুললাম
তো ছবি, তাতে দেখি ভারতমাতা আর মীরাবাই খামচাখামচি করছে আর ঝাঁসির রানী তরোয়াল বাগিয়ে
কোনটাকে আগে পেটাবে তাই ভাবছে। কি অপূর্ব ছবি, ভাবছি ‘অগ্নিকন্যা’ ক্যাপশন দেব
কিনা, চোখে পড়ে কে যেন এসে ম্যাপ-টা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁ হাঁ করে উঠতে গিয়ে দেখি
তিতিরের ক্লাস টিচার – মাতৃদেবী সলজ্জ মুখে জানান টিচাররা নাকি বলেছেন ঐ ম্যাপ এখন
থেকে স্কুলে সাজিয়ে রাখা হবে। ভ্যাবলাপানা হাসিমুখে দেখি আমার এই এত ঘন্টার
পরিশ্রমের ফসল ম্যাপ, মায় ফ্ল্যাগটা অবধি দুই টিচারের হাতে অন্তর্হিত হল। কি ভাগ্যিস
আলমারির কি মপারের রড খুলে ফ্ল্যাগের ডান্ডা বানাইনি!
---
এক বিশাল পর্ব নির্বিঘ্নে সমাপন করায় মন বেশ
প্রফুল্ল ছিল। রাত্রে ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ গাইতে গাইতে
ঘুমোতে যাচ্ছিলুম, কন্যার প্রশ্ন,
“জননী মানে মা তো?”
“হ্যাঁ মা। ভারতবর্ষ আমাদের দেশ তো, দেশকে ভালবেসে মা বলা হচ্ছে।”
“ভারতবর্ষ আমাদের মা?”
“হ্যাঁ, তাই তো বলছে।”
“আর ভারতবর্ষ আছে পৃথিবীর মধ্যে, তাই তো?”
“ঠিক।”
“তাহলে পৃথিবী হল ভারতবর্ষের মা, মানে পৃথিবী
আমাদের দিম্মা।”
নিজের মা আর দিম্মাকে যুগপৎ হতভম্ব করিয়ে দিয়ে
ছোট্ট মেয়ে শুতে চলে গেল।