আন্টি বড়ই ভালমানুষ, সে
শুধু বলতে গেছিল, “তোমার ওখানে একটা বন্ধু হবে, বেশ খেলা করতে পারবে...”
“কে গো? কে গো মা?”
“ওই যে, আমরা যাকে দেখতে
যাচ্ছি!”
“ দ্যূৎ! ওটা তো বেবি!”
তারপর আন্টির দিকে ফিরে
পরম গম্ভীরভাবে, “আমি ফাইব ঈঈর্স হয়ে গেছি, জানো না?”
-----
বোম্বের এক প্রান্ত থেকে
আরেক প্রান্ত যাত্রা। প্রতিবার এমন জার্নি করলেই মনে হয় শরীরে এত হাড়গোড় কেন যে
আছে! তিতির যথারীতি মাথা খেয়ে ফেলছে “আর কদ্দূর” করে করে। অগত্যা অক্ষর দিয়ে শব্দ
বলার খেলা খেলতে শুরু করি।
“পা” – তিতির বলে।
“পাহাড়” – আন্টি জোড়ে।
“পাতাল” – আমার ফোড়ন।
প্রবেশের ইচ্ছাসহ।
“পাপোশ” – সামনের সীট
থেকে আঙ্কল।
এইভাবে ‘পাখি’, ‘পালকি’, ‘পাথর’
করে করে পা-এর সম্ভার ফুরিয়ে যায়। আঙ্কল এবার নতুন অক্ষর দেয় – ‘কি’।
কিছুই মনে পড়ছে না যে! ও
হ্যাঁ, ‘কিছু’!
“কি! চাবি!” – তিতিরের দাবি।
না তিতির, ওটা ইংলিশ।
বাংলা বল।
“কিলবিল” – আন্টি এতক্ষণ
ভেবে বার করে।
বলামাত্র তিতির এইসা
কিলবিল করার ডেমো দিতে থাকে যে আমার হাত থেকে চশমার খাপ, আন্টির হাত থেকে জলের
বোতল এবং তিতিরের পা থেকে জুতো খসে পড়ে যায়।
কিন্তু আর যে কিছু মনে
পড়ছে না আমার, ‘কিষাণ বিকাশ পত্র’ ছাড়া!
আঙ্কল সামনে থেকে বলে ‘কিষ্কিন্ধ্যা’।
তিতিরকে বোঝাতে হয় সেটা
কি। রামায়ণ দেখা, তাই অসুবিধে হয় না। ওদিকে আঙ্কল মুডে এসে গেছে। এবার বলে, “কিচক!”
এটা আমি প্রতিবাদ করতে
বাধ্য হই। “ক এ ঈ তো সেটা। হবে না!”
আঙ্কল অদম্য। বলে, “কিংকর্তব্যবিমূঢ়!”
এমন শব্দাঘাতে কিনা জানি
না, তিতির এর পর ঘুমিয়ে পড়ে। আরো কতক্ষণ ধরে গাড়ির স্রোত পেরিয়ে, সিগনালে গোঁত্তা
খেয়ে খেয়ে, জি পি এসের চক্করে চক্কর কেটে অবশেষে গিয়ে পৌঁছই।
-----
আহা কি মিষ্টি বেবি গো!
কিন্তু তাকে নিয়ে বেশিক্ষণ খেলতে পারলুম না, আমার বেবিটির ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে। ভাতের
থালা নিয়ে বসে পড়ি।
বসে একটু বেকায়দায় পড়ি।
যাই দেখাই মেয়ে ডুগডুগ করে মাথা নেড়ে বলে ‘এটা খাব না’।
ওদিক থেকে বন্ধুর
প্রস্তাব – “ও না খেতে চাইলে আমায় বলিস।”
তোকে? মানে তুই খাইয়ে
দিবি? এত খুশি বহুকাল হইনি। রীতিমত কৃতজ্ঞ বোধ করতে থাকি।
“ও যা যা না খাবে আমি
খেয়ে নেব।”
অ্যাঁ!!! ধুত্তোর...বাজে
বদ রেকারিং ডেসিমেল কোথাকার!
এমনকি তিতিরও ফ্যাক ফ্যাক
করে হেসে ফ্যালে আঙ্কলের কথা শুনে।
----------
আরো দুই খুকি আসে অভ্যাগত
হয়ে। একজন তিতিরের চেয়ে একটু বড়, অন্যজন একটু ছোট। ভাব হতে বেশি সময় লাগে না। তিতির
অলরেডি একটা পিঙ্ক ডলফিন সফট টয় জোগাড় করে ফেলেছিল এসেই, দ্বিতীয়া দেখি একটা
রাবারের ফোলানো মাছ পেয়েছে কুড়িয়ে। দুজনে সে দুটো ঠেকিয়ে “পিঙ্ক পিঙ্ক ম্যাচিং
ম্যাচিং” করছে দেখে আমি, সরল, নিরীহ, দরদী হৃদয়ে তৃতীয়াকে বলতে গেলুম, “তোমার
জামাটা তো পিঙ্ক, ম্যাচিং ম্যাচিং!”
তিনি অবিকল তিতিরের মত
ভ্রূ কুঁচকে আমায় ধমকে দিলেন, “পিঙ্ক নয়, পীচ।”
অসীম লজ্জায় পড়ে যাই। এই
ধেড়ে বয়েসেও এসব বর্ণবিচার করতে পারি না, কি হবে বল দিকি আমার!
ওদিকে তিতির জিগ্যেস করতে
থাকে, পানের পিচ কি এমন রং এর হয়, কারণ রাস্তার পিচ তো কালো মানে ব্ল্যাক! হাসি
টাসি চেপে বোঝাই যে এটা সেসব নয়, এমনকি আঙ্কলরা যা নিয়ে এত চিন্তিত সেই ক্রিকেট
মাঠের পিচও না, এটা একটা ফলবিশেষ। তাতে বিশেষ হুকুম হয় যে শিগগির যেন সেটা এনে
দেখাই।
---------
তিনকন্যার তুমুল হট্টরোলে
বেবির গেল ঘুম ভেঙ্গে।অমনি খুদে দিদিদের দাবি, তারা বেবিকে কোলে করবে। তাদের খাটের
ওপর সেট করে, অনভ্যস্ত কোলে বেবিকে দিয়ে কটা ছবি তোলা হয় – তিন ত্রস্ত মা আশেপাশে
ফিল্ডারের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকে।
যেই না ছবি তোলা শেষ
হয়েছে, তিতির দেখি বাকি দুজনের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, “চল এবার আমরা
কথাবার্তা বলি।”
---------------
কি কথাবার্তা হয় সারাদিন
ধরে জানি না। মাঝে মাঝে ঝড়ের মত তিনজন বেরিয়ে আসে, আমাদের সোফার চারদিকে বোঁ বোঁ
করে ঘুরপাক খায়, তারস্বরে হাসে, মিছিমিছি টুপি খুলে আমাদের ‘বাও’ করে, আবার ঘরে
ঢুকে সেই মিস্টিরিয়াস ‘কথাবার্তা’ বলতে লেগে যায়।
সে কথাবার্তার কিছু নমুনা
পাই বিকেলে, তিতিরের চুল বাঁধতে বসে। আমি খাটে থেবড়ে বসেছি (আমার যা নধরকান্তি
তনু, ধেবড়ে বসেছি বললেই হয়তো বেটার হয়।) আমার সামনে তিতির বাবু হয়ে, পিঠ ফিরিয়ে,
আর তার সামনে তার নতুন বান্ধবী, সেও পরিপাটি বাবু, আমাদের দিকে ফিরে। কেশচর্চা
করতে করতে শুনে যাই,
“আমার ডলফিন আছে।”
“আমারও আছে।”
“আমার এলিফ্যান্ট আছে।”
“আমারও আছে।”
“আমার দুটো আছে।”
“আমার তিনটে...না, চারটে
আছে।”
এতগুলো ঢপ, এই আশায়
বান্ধবী আমার দিকে সসংশয়ে তাকায়। তিতিরও আধখানা ঘুরে যুদ্ধং দেহি ঢং এ তাকায়
(চুলের গোড়া আমার হাতে তাই পুরো ঘুরতে পারে না।) তাল মিলিয়ে বিনুনি সামলাতে গিয়ে
ডি এন এর মত পেঁচিয়ে যাওয়া অবস্থায় বলতে
বাধ্য হই যে সত্যিই চারটে আছে বটে।
“আমার এলিফ্যান্টগুলো
তোরগুলোর চেয়ে অনেক বড় বড়!”
“বড় না।”
“বড়!!!”
“আমার খাসনবীশ আছে!”
“কি?”
“খাসনবীশ”
(আমি প্রাণপণে হাসি
চাপছি)
“কিইই??”
“খাসনবীশ। ভ্যাবাচ্যাকা
খাসনবীশ।”
(পুরো মাই নেম ইজ বন্ড।
জেমস বন্ড।)
বালিকা নিজেই
ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে আমার দিকে আকুল চোখে তাকায়। বুঝিয়ে বলি যে তিতিরের একটা হাসিমুখো
কাপড়ের পুতুল আছে, তার নাম ভ্যাবাচ্যাকা খাসনবীশ।
ও বাবা, এ খুকু দেখি
অপ্রতিরোধ্য! বুঝে নিয়েই বলে বসে,
“আমারও আছে।”
“হতেই পারে না! তোর নেই!”
“আছে! আমারও অমন ডল আছে।
আমি আজ গিয়েই তার নাম ভ্যাবাচ্যাকা খাসনবীশ করে দেব।”
বোঝো!
মনে পড়ল কিছুকাল আগে,
একটি কচি বছর দেড়ের স্বল্পভাষী কন্যা বেড়াতে এসে তিতিরের খেলনাসমূহ দেখে গেছিল। খাসনবীশ
কেও। তার কিছুদিন পর তার মা মেসেজ করে জানালেন সে তিনি একটি নতুন ডল প্রাপ্ত
হইয়াছেন, এবং পাওয়ামাত্র নির্দ্বিধায় নাম ঘোষণা করেছেন, “ভ্যাবাচ্যাকা!” এই রেটে
চললে, অচিরাৎ সব চেনাজানা শিশুর বাড়িতে এক পীস করে ভ্যাবাচ্যাকা খাসনবীশ অধিষ্ঠান
করবে, যা দেখছি!
এদিকে তিতিরের চোখের জল
প্রায় গড়িয়ে পড়ে আর কি! আঁই আঁই করে নালিশ করে যাচ্ছে ভ্যাবাচ্যাকার ওপর এরকম আগ্রাসনের
বিরুদ্ধে। ওদিকে আমি সবে একখানা বিনুনি শেষ করে অন্যদিকেরটা পেঁচাতে শুরু করেছি,
এখন স্থিরমাথায় বসিয়ে রাখতে না পারলে চিত্তির! সুতরাং কথা ঘুরিয়ে দিই।
“জানিস তো, আমাদের বাড়ির
পাশে না, একটা আমগাছ আছে।”
“আমাদেরও আছে।”
ভারি খুশি হই। এমন লড়াকু
ছানা আমার ভারি পছন্দ। কিন্তু তিতির ফুঁসে ওঠে,
“তাতে কাঠবিড়ালি আছে।”
প্রতিপক্ষ একটু মিইয়ে
যায়। তিতির তাতে আরো উৎসাহিত হয়ে ওঠে,
“কাঠবিড়ালি আছে, মাংকি
আছে, টিয়াপাখি আছে।”
“সত্যিকারের টিয়াপাখি?”
“হ্যাঁ তো! অনেক আছে।
ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকে না?”
শান্তিস্থাপনার সুযোগ
পাওয়া গেছে, ছাড়ি!
“তিতির বন্ধুকে বল আমাদের
বাড়ি আসতে? টিয়াপাখি দেখবে?”
তিতির ভারি খুশি হয়ে ‘নেওতন্ন’
করে ফ্যালে। সে বালিকা ততোধিক খুশি হয়ে সে ‘নেওতন্ন’ গ্রহণ করে ফ্যালে। আহ্লাদে
গলে জল হয়ে দুজনে দুজনের হাত জড়িয়ে ধরে বসে থাকে, কে বলবে এইমাত্র শিং এ শিং ভেড়ার
লড়াই হচ্ছিল! আমি সেই ফাঁকে শিং এর, মানে বিনুনির বাকিটুকু শেষ করে, দুদিকে দুটো
ক্লিপ আটকে স্যাট করে পালাই।
পাগল! আর উলুখাগড়া হবার
রিস্ক নিতে আছে, এক্ষুণি ‘কথাবার্তা’ শুরু হল বলে আবার!