তিনকন্যা এরোপ্লেন করে কলকাতা
যাচ্ছিলেন। বড়জন কুর্তা লেগিংস, পিঠে দুম্বো ব্যাকপ্যাক, ডানহাতে বোর্ডিং পাস আর
ব্যাগ, বাঁহাতে মেজোজনের হাত ধরা। মেজোজন টি শার্ট
পাৎলুন, ডানহাত তো আগেই বললাম, বড়জন দ্বারা ধৃত, বাঁহাতে ছোটজনের কোমর ধরা। ছোটজন অরেঞ্জ
গাউন, দুহাত খালি।
হ্যাঁ, কোমর ধরা। অত ছোট পুতুল আর
কী করেই বা ধরবে! তবে, সে
কিনা আপাতত মেজোজনের ‘বেইবি’, তাই
তাঁকে পুতুল বলা নিষিদ্ধ।
এইভাবে ‘হাতে হাতে ধরি ধরি’
করে তো প্লেনে উঠে বসা গেল। জানলার ধারের সীটে ছোট দুটো, মাঝের সীটে আমি। ওমা, পাশের সীটে দেখি সেই তেঢ্যাঙা, একহারা, নীল চোখো, তরুণ
সাহেবছানা কী জানি কোন দেশের! কিছু বলার আগেই আমায় ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে সে আমার
হাতের হলদে হাতবাক্স (তিতিরের ‘সুক্কেশ’। ভর্তি খালি
খেলনা পুতুল রঙের বই চুলের ক্লিপ আর আমার অজানা আরো কিসব!) পট্ করে কেড়ে নিয়ে
উপরের তাকে তুলে দিল। পিঠের ব্যাগও খুলে নিতে যাচ্ছিল, হাঁ হাঁ করে থামাই,
ওতে খাবারদাবার বইখাতা আছে, প্লেনে লাগবে।
প্লেন উড়েছে আকাশে, তিতির যথারীতি উসখুস করছে আর প্রশ্নের পর
প্রশ্ন করছে। সামনের পকেটে
রাখা ম্যাগাজিনটা বার করে হাতে ধরিয়ে দিই। মেয়ে এটা ওটা সেটা দেখে ইন্ডিগোর ফ্লাইট রুট দেওয়া ভারতের
ম্যাপটা বার করে ফেলে।
আমরা কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি সেসব দেখিয়ে দেওয়ার পর
অবধারিত শুরু হল, একেকটা রাজ্যের গায়ে হাত রেখে ‘এটা কোন জায়গা’ বলে প্রশ্ন। ঝাড়খণ্ড,
দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ পেরিয়ে যেই গুজরাত বলেছি, কথা নেই বার্তা নেই তিতির পিলে চমকানো হাঁক ছাড়ল,
“গুজরাত কি জ্য্যায় হো!”
ততোধিক পিলে চমকিয়ে
পিছনের সীট থেকে ধমকের সুরে জবাব এল,
“কেন রে? গুজরাত কি জ্জ্যায় দিচ্ছিস? কেন, বাংলা কি জ্জ্যায় বলতে পারছিস না?”
আপনারা কজন পাড়ায়
চরেবরে বড় হয়েছেন জানি না। ‘আমার
পাড়া’ বলার একাত্মবোধটাও কজন আজকের দিনে বোঝে সেটাও জানি না। আমার ছোটবেলাটা কেটেছে পাড়ায়, সিঁথির সে অঞ্চল তখনো সামান্য ব্রাত্য খাস কল্কাত্তাইয়া (যার
সীমা এদিকে ধর্মতলা ওদিকে বাগবাজার এপাশে গঙ্গা আর ওপাশে মানিকতলা) দের কাছে, সে পাড়ায় অলিগলিতে গাড়ির ভয় না করে ব্যাডমিন্টন খেলা যেত, সাইকেল নিয়ে পাক খাওয়া যেত, বাড়ির জানলায় ফ্লাডলাইট
বেঁধে মাঠে সন্ধেরাতে ফুটবল টুর্নামেন্ট হত, সরস্বতী পুজোর বসে
আঁকো প্রতিযোগিতা হত। রক ছিল না, কিন্তু বিশুদাদের বাড়ির সিঁড়িতে কি গলির
মোড়ে দাঁড়িয়ে দাদা-কাকুদের হো-হো হাসির আড্ডা ছিল, এ বাড়ির মিত্তিরকাকিমা
ছেলেকে গানের স্কুলে নিয়ে গেলে ওবাড়ির টুম্পাকেও ডেকে একসঙ্গে নিয়ে চলে যাওয়া ছিল। আর ছিল কিছু
উল্টোপাল্টা করলে বা বললে, এইরকম
স্বতঃস্ফূর্ত ধমক, কাকু মাসি দাদু জেঠিমাদের থেকে। তখনো ঐ “পরের
বাচ্চা আমার কী, তার যা হয় হোক, বললে তাঁর বাড়ির লোক কী মনে করবে”র মেকি ভদ্রতা আমাদের মুড়ে ফেলেনিতো!
ঘাড় ঘোরানোরও আগে
জানতাম, এক সৌম্য বয়স্ক সহৃদয় মুখ দেখব।
তিতির মুহূর্তের মধ্যে
“দাদু” পাতিয়ে ফেলল। শুধু পাতিয়েই
ফেলল না, তার দাদুকে এমনই “ফ্রেণ্ড” মনে হল যে
জিজ্ঞেসও করে ফেলল ক্লাস ওয়ানে পড়ে কিনা!
তারপর দাদুকে ‘বেইবি’ দেখানো হল, তারপর ভুলিয়ে ভালিয়ে বেইবিকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হল, বেচারা ভদ্রলোক পুতুল কোলে বসে রইলেন – এয়ারহোস্টেসরা সবাই ছুতো করে ঘুরে
ঘুরে সেটা দেখে ফিক ফিক করে হেসে গেল। আর নিরন্তর
আলাপচারি চলল দুজনের, বাংলা
ভাষার খুঁটিনাটি থেকে প্লেনটা আরেকটু জোরে গেলেই চাঁদের মাথায় হাত বোলানো যাবে
কিনা অবধি কিছুই বাদ রইল না সেই আন্তরিক সহর্ষ কথোপকথনে।
ততক্ষণে আমার
পার্শ্ববর্তী সাহেব ঘুমিয়ে কাদা। তিতিরের ভারি ইচ্ছে তার মাথার টুপিটা খুলে নিয়ে নিজে পরে। কিন্তু অবশ্যই, নিজের সাহসে কুলোচ্ছে না, কাজেই আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে। সে বায়নার
মাত্রা একটু বেড়ে যেতে নতুন পাওয়া দাদু পিছন থেকে সামাল দেবার চেষ্টা করলেন, ‘টুপি খুলে নিলেই
কিন্তু রেগে গিয়ে তোর নাক কেটে দেবে কুচ্ করে!’
এক সেকেণ্ড, মাত্র এক সেকেণ্ডের বিরতি। তারপরই জবাব
হাজির,
“কী দিয়ে কাটবে শুনি? কেঁইচি নিয়ে উঠতে দেয় না প্লেনে জানো না?”
দাদু বাকরহিত, তাঁর পাশের জন চাপা হাসিতে উদ্বেলিত, আমি ‘দোষ কারো নয় তো মাআআ!’
নেহাৎ আমাদের কথার
ঠেলায় একটু পরেই সে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ল, তাই বেঁচে গেলুম।
তারপর, খাদ্যাদির আগমন ঘটল। আমায় প্রবল
লজ্জিত করে, কোন আপত্তিতে কান
না দিয়েই দাদু তিতিরকে একটা ট্রীটও দিলেন।
দুরন্ত কন্যাকে স্থির
হয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য খাতা পেন্সিল বার করে দিয়েছিলুম। ফলে,
আহারপর্ব সমাধান হতেই দাদু পড়লেন নতুন বিপদে। খাতা বাগিয়ে তিতির হুকুম করল, এ বি সি ডি লেখো, ভুল হলেই কেটে দেব
কিন্তু!
ভদ্রলোককে দেখে, এবং পার্শ্ববর্তীর সঙ্গে কথাবার্তা শুনে
ততক্ষণে বুঝে নিয়েছি কোন কোম্পানীর বেশ উচ্চপদস্থ ব্যক্তি। ভোরের প্লেনে
এসেছেন বোম্বে, মিটিং সেরে
বিকেলেই ফিরে যাচ্ছেন। তিনি কাঁচুমাচু হয়ে বসে এ-বি-সি-ডি লিখছেন দেখে বেজায় হাসি
পাচ্ছিল। লেখা শেষ হতে খাতা দেখতেও দিলেন আবার! তা, সবই যেহেতু ঠিক লিখেছেন, দশ এ দশ পেলেন। এমনি না,
খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে, তাতে নম্বর লিখে, উপরে ফুল পাতা এঁকে, নীচে হিজিবিজি সই করে, দাদুর নাম জিজ্ঞাসা করে (সুদীপ) সেটা মায়ের থেকে বানান জেনে নিয়ে লিখে, রীতিমত রিপোর্ট কার্ড বানিয়ে দেওয়া হল তাঁকে।
দাদুও তেমনই স্পোর্টিং। অমনি তাঁর পাশের
বাঙালী সহকর্মী ও সহযাত্রী এবং তারও পাশের অবাঙালী মহিলা – দুজনকে ডেকে ডেকে
দেখিয়ে দিলেন যে তিনি রিপোর্ট কার্ডে দশে দশ পেয়েছেন। অন্য বাঙালী
ভদ্রলোকটি বললাম তো এদের কাণ্ড দেখে মজা পাচ্ছিলেন, তিনি বেশ হাততালি টালি দিয়ে জমিয়ে দিলেন। মহিলা কিছু
বিশেষ বোঝেননি এতক্ষণ ,
রীতিমত ভেবলে গেলেন প্রথমে, তারপর বুঝিয়ে দিতে তিনিও ভারি
খুশি হয়ে কনগ্রাচুলেট করে ফেললেন।
এই অবধি বেশ চলছিল। এরপর তিতির ছবি আঁকতে শুরু করল। প্রজাপতি হাতি এসব হয়ে , কী যেন একটা এঁকে দাদুকে দেখাল।
“কে রে?”
“শিবঠাকুর নাচছে, দেখছে না?”
“এটা শিবঠাকুর? না উদয়শংকর?”
সেই প্রথম ‘জ্য্যয় হো’ বলায় দাদু
যেমন ধমক দিয়েছিলেন, তার দ্বিগুণ জোরে ধমক খেলেন এবার, “শিবঠাকুর-ই তো! দেখছ না মাথায় খোঁপা?”
ভদ্রলোকের হতভম্ব ভাব
কাটিয়ে ওঠার পর হা-হা হাসিটা অনেকদিন মনে থাকবে আমার।
আজ লিখতে বসে মনে
হচ্ছে, কেমন হঠাৎ পথচলতি কুড়িয়ে পাওয়া গেল
ছোট্টবেলার পাড়ার একটা টুকরো, সেই সময়ের অন্যের ভালো চাওয়া
খেয়াল রাখা মানুষগুলোর একফোঁটা মনের ছোঁয়া।
কে জানে হয়তো কলকাতার
কোন অজানা ঘরে বসে, এক
প্রৌঢ় ভদ্রলোকও ঠিক এই মুহূর্তে চায়ের কাপ হাতে আবার হেসে ফেলছেন “শিবের মাথায়
খোঁপা’ আঁকা এক ছোট্ট মেয়ের কথা ভেবে...
কতজন যে কতভাবে
ভালবাসায় ঋণী করে যায়...,