Sunday 21 January 2018

প্লেনযাত্রা


তিনকন্যা এরোপ্লেন করে কলকাতা যাচ্ছিলেন বড়জন কুর্তা লেগিংস, পিঠে দুম্বো ব্যাকপ্যাক, ডানহাতে বোর্ডিং পাস আর ব্যাগ, বাঁহাতে মেজোজনের হাত ধরা মেজোজন টি শার্ট পাৎলুন, ডানহাত তো আগেই বললাম, বড়জন দ্বারা ধৃত, বাঁহাতে ছোটজনের কোমর ধরা ছোটজন অরেঞ্জ গাউন, দুহাত খালি
হ্যাঁ, কোমর ধরা অত ছোট পুতুল আর কী করেই বা ধরবে! তবে, সে কিনা আপাতত মেজোজনের বেইবি’, তাই তাঁকে পুতুল বলা নিষিদ্ধ
এইভাবে হাতে হাতে ধরি ধরি করে তো প্লেনে উঠে বসা গেল জানলার ধারের সীটে ছোট দুটো, মাঝের সীটে আমি ওমা, পাশের সীটে দেখি সেই তেঢ্যাঙা, একহারা, নীল চোখো, তরুণ সাহেবছানা কী জানি কোন দেশের! কিছু বলার আগেই আমায় ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে সে আমার হাতের হলদে হাতবাক্স (তিতিরের সুক্কেশ ভর্তি খালি খেলনা পুতুল রঙের বই চুলের ক্লিপ আর আমার অজানা আরো কিসব!) পট্‌ করে কেড়ে নিয়ে উপরের তাকে তুলে দিল পিঠের ব্যাগও খুলে নিতে যাচ্ছিল, হাঁ হাঁ করে থামাই, ওতে খাবারদাবার বইখাতা আছে, প্লেনে লাগবে
প্লেন উড়েছে আকাশে, তিতির যথারীতি উসখুস করছে আর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে সামনের পকেটে রাখা ম্যাগাজিনটা বার করে হাতে ধরিয়ে দিই মেয়ে এটা ওটা সেটা দেখে ইন্ডিগোর ফ্লাইট রুট দেওয়া ভারতের ম্যাপটা বার করে ফেলে
আমরা কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি সেসব দেখিয়ে দেওয়ার পর অবধারিত শুরু হল, একেকটা রাজ্যের গায়ে হাত রেখে এটা কোন  জায়গা বলে প্রশ্ন ঝাড়খণ্ড, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ পেরিয়ে যেই গুজরাত বলেছি, কথা নেই বার্তা নেই তিতির পিলে চমকানো হাঁক ছাড়ল, “গুজরাত কি জ্য্যায় হো!”
ততোধিক পিলে চমকিয়ে পিছনের সীট থেকে ধমকের সুরে জবাব এল,
“কেন রে? গুজরাত কি জ্জ্যায় দিচ্ছিস? কেন, বাংলা কি জ্জ্যায় বলতে পারছিস না?
আপনারা কজন পাড়ায় চরেবরে বড় হয়েছেন জানি না আমার পাড়া বলার একাত্মবোধটাও কজন আজকের দিনে বোঝে সেটাও জানি না আমার ছোটবেলাটা কেটেছে পাড়ায়, সিঁথির সে অঞ্চল তখনো সামান্য ব্রাত্য খাস কল্কাত্তাইয়া (যার সীমা এদিকে ধর্মতলা ওদিকে বাগবাজার এপাশে গঙ্গা আর ওপাশে মানিকতলা) দের কাছে, সে পাড়ায় অলিগলিতে গাড়ির ভয় না করে ব্যাডমিন্টন খেলা যেত, সাইকেল নিয়ে পাক খাওয়া যেত, বাড়ির জানলায় ফ্লাডলাইট বেঁধে মাঠে সন্ধেরাতে ফুটবল টুর্নামেন্ট হত, সরস্বতী পুজোর বসে আঁকো প্রতিযোগিতা হত রক ছিল না, কিন্তু বিশুদাদের বাড়ির সিঁড়িতে কি গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে দাদা-কাকুদের হো-হো হাসির আড্ডা ছিল, এ বাড়ির মিত্তিরকাকিমা ছেলেকে গানের স্কুলে নিয়ে গেলে ওবাড়ির টুম্পাকেও ডেকে একসঙ্গে নিয়ে চলে যাওয়া ছিল আর ছিল কিছু উল্টোপাল্টা করলে বা বললে, এইরকম স্বতঃস্ফূর্ত ধমক, কাকু মাসি দাদু জেঠিমাদের থেকে তখনো ঐ “পরের বাচ্চা আমার কী, তার যা হয় হোক, বললে তাঁর বাড়ির লোক কী মনে করবে”র মেকি ভদ্রতা আমাদের মুড়ে ফেলেনিতো!
ঘাড় ঘোরানোরও আগে জানতাম, এক সৌম্য বয়স্ক সহৃদয় মুখ দেখব
তিতির মুহূর্তের মধ্যে “দাদু” পাতিয়ে ফেলল শুধু পাতিয়েই ফেলল না, তার দাদুকে এমনই “ফ্রেণ্ড” মনে হল যে জিজ্ঞেসও করে ফেলল ক্লাস ওয়ানে পড়ে কিনা!
তারপর দাদুকে বেইবি দেখানো হল, তারপর ভুলিয়ে ভালিয়ে বেইবিকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হল, বেচারা ভদ্রলোক পুতুল কোলে বসে রইলেন – এয়ারহোস্টেসরা সবাই ছুতো করে ঘুরে ঘুরে সেটা দেখে ফিক ফিক করে হেসে গেল আর নিরন্তর আলাপচারি চলল দুজনের, বাংলা ভাষার খুঁটিনাটি থেকে প্লেনটা আরেকটু জোরে গেলেই চাঁদের মাথায় হাত বোলানো যাবে কিনা অবধি কিছুই বাদ রইল না সেই আন্তরিক সহর্ষ কথোপকথনে
ততক্ষণে আমার পার্শ্ববর্তী সাহেব ঘুমিয়ে কাদা তিতিরের ভারি ইচ্ছে তার মাথার টুপিটা খুলে নিয়ে নিজে পরে কিন্তু অবশ্যই, নিজের সাহসে কুলোচ্ছে না, কাজেই আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে সে বায়নার মাত্রা একটু বেড়ে যেতে নতুন পাওয়া দাদু পিছন থেকে সামাল দেবার চেষ্টা করলেন, টুপি খুলে নিলেই কিন্তু রেগে গিয়ে তোর নাক কেটে দেবে কুচ্‌ করে!
এক সেকেণ্ড, মাত্র এক সেকেণ্ডের বিরতি তারপরই জবাব হাজির,
“কী দিয়ে কাটবে শুনি? কেঁইচি নিয়ে উঠতে দেয় না প্লেনে জানো না?
দাদু বাকরহিত, তাঁর পাশের জন চাপা হাসিতে উদ্বেলিত, আমি দোষ কারো নয় তো মাআআ!
নেহাৎ আমাদের কথার ঠেলায় একটু পরেই সে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ল, তাই বেঁচে গেলুম
তারপর, খাদ্যাদির আগমন ঘটল আমায় প্রবল লজ্জিত করে, কোন আপত্তিতে কান না দিয়েই দাদু তিতিরকে একটা ট্রীটও দিলেন
দুরন্ত কন্যাকে স্থির হয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য খাতা পেন্সিল বার করে দিয়েছিলুম ফলে, আহারপর্ব সমাধান হতেই দাদু পড়লেন নতুন বিপদে খাতা বাগিয়ে তিতির হুকুম করল, এ বি সি ডি লেখো, ভুল হলেই কেটে দেব কিন্তু!
ভদ্রলোককে দেখে, এবং পার্শ্ববর্তীর সঙ্গে কথাবার্তা শুনে ততক্ষণে বুঝে নিয়েছি কোন কোম্পানীর বেশ উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ভোরের প্লেনে এসেছেন বোম্বে, মিটিং সেরে বিকেলেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি কাঁচুমাচু হয়ে বসে এ-বি-সি-ডি লিখছেন দেখে বেজায় হাসি পাচ্ছিল লেখা শেষ হতে খাতা দেখতেও দিলেন আবার! তা, সবই যেহেতু ঠিক লিখেছেন, দশ এ দশ পেলেন এমনি না, খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে, তাতে নম্বর লিখে, উপরে ফুল পাতা এঁকে, নীচে হিজিবিজি সই করে, দাদুর নাম জিজ্ঞাসা করে (সুদীপ) সেটা মায়ের থেকে বানান জেনে নিয়ে লিখে, রীতিমত রিপোর্ট কার্ড বানিয়ে দেওয়া হল তাঁকে
দাদুও তেমনই স্পোর্টিং অমনি তাঁর পাশের বাঙালী সহকর্মী ও সহযাত্রী এবং তারও পাশের অবাঙালী মহিলা – দুজনকে ডেকে ডেকে দেখিয়ে দিলেন যে তিনি রিপোর্ট কার্ডে দশে দশ পেয়েছেন অন্য বাঙালী ভদ্রলোকটি বললাম তো এদের কাণ্ড দেখে মজা পাচ্ছিলেন, তিনি বেশ হাততালি টালি দিয়ে জমিয়ে দিলেন মহিলা কিছু বিশেষ বোঝেননি এতক্ষণ , রীতিমত ভেবলে গেলেন প্রথমে, তারপর বুঝিয়ে দিতে তিনিও ভারি খুশি হয়ে কনগ্রাচুলেট করে ফেললেন
এই অবধি বেশ চলছিল এরপর তিতির ছবি আঁকতে শুরু করল প্রজাপতি হাতি এসব হয়ে , কী যেন একটা এঁকে দাদুকে দেখাল
“কে রে?
“শিবঠাকুর নাচছে, দেখছে না?
“এটা শিবঠাকুর? না উদয়শংকর?
সেই প্রথম জ্য্যয় হো বলায় দাদু যেমন ধমক দিয়েছিলেন, তার দ্বিগুণ জোরে ধমক খেলেন এবার, “শিবঠাকুর-ই তো! দেখছ না মাথায় খোঁপা?
ভদ্রলোকের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ওঠার পর হা-হা হাসিটা অনেকদিন মনে থাকবে আমার
আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে, কেমন হঠাৎ পথচলতি কুড়িয়ে পাওয়া গেল ছোট্টবেলার পাড়ার একটা টুকরো, সেই সময়ের অন্যের ভালো চাওয়া খেয়াল রাখা মানুষগুলোর একফোঁটা মনের ছোঁয়া
কে জানে হয়তো কলকাতার কোন অজানা ঘরে বসে, এক প্রৌঢ় ভদ্রলোকও ঠিক এই মুহূর্তে চায়ের কাপ হাতে আবার হেসে ফেলছেন “শিবের মাথায় খোঁপা আঁকা এক ছোট্ট মেয়ের কথা ভেবে...
কতজন যে কতভাবে ভালবাসায় ঋণী করে যায়...,

Saturday 6 January 2018

দেখভাল


না, বাড়িতে দু দুটো মা থাকা ভারি গণ্ডগোলের ব্যাপার। আমি তো চিরকালের ভালমানুষনিপীড়িত, নিরীহ মানুষ - দিম্মা আর তাঁর 'নান্নী' দুজনে মিলে এইসা দেখভাল করছে আমার যে ত্রাহি মধুসূদন ডাক আসন্ন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে মধুসূদন, অর্থাৎ দাদুমণি, বই-কাগজ কিছু একটার আড়ালে আত্মগোপন করে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন, কাজেই ডাক পাঠিয়েও লাভ বিশেষ নেই মনে হয়।                                               

আপিশ থেকে ফিরলুম কি ফিরলুম না, দুই অসমবয়সী অসমায়তন মাতৃদেবী আমার দুহাত ধরে সমান ইন্টেন্সিটির ঝুলোঝুলি করতে লাগলেন - একজন তালের বড়া খাবার জন্য, অন্যজন ঘোড়া সেজে পিঠে নেবার জন্য। দুটোই মহৎ প্রস্তাব, কিন্তু একসাথে দুটো করা যে নেহাৎ অসম্ভব, সে চেষ্টা করাও যে মূর্খতা, সে তো বলাই বাহুল্য। আর পেটে দানাপানি না পড়লে কি আর ঘোড়া চলতে পারে, কাজেই আগে কোনটা করতে হবে তাও বোঝা সহজ। সুতরাং, 'ছোট্ট মা'টাকে ট্যাঁকসই করে, হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে টরেটক্কা বাজাতে লাগলুম।  

"মা, মা, আজ না, জানো তো একজনকার  জম্মদিন ছিল, পুঁ পুঁ বাঁশি দিছে।

"একজনের জন্মদিন। দিছে না, দিয়েছে।"  

"বাঁশি বাজাই, মা? বাজাই এনে?"  

কেষ্টার বাঁশির যতই গুণগান গাওয়া হোক, খিদের মুখে কানের গোড়ায় পিলে চমকানো হুইসল মোটে ভাল না। বলে রাখলুম আপনাদের।    

"কে রে এই বন্ধু?"    

"আদ্রিজা রাজহাঁস।"     

হাঁসদা পদবী হয় শুনেছি। তা বলে রাজহাঁস? জিগানোর আগে নিজেই শুধরে নিল, "রাজহাঁস না, রাজ। শুধু রাজ। আদ্রিজা রাজ।"      

বেকুব হয়ে চেয়ে থাকি। রাজ কে রাজহাঁস বলছে! ভারতীয় ক্রিকেট দলের এক  ক্যাপ্টেনের, মহারাষ্ট্রের এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার মুখগুলো মনে পড়ে। রাজহাঁস? পেটের মধ্যে কুলকুল করে হাসির ঘূর্ণি গজাচ্ছে টের পাই।  

কিন্তু হাসতে পারি না। চোখের সামনে ফুটে ওঠে বিডন স্ট্রীট থেকে বেরোনো একটা রাস্তার ফুটপাথ। সাদা স্কুলড্রেস পরা একটা তিতিরের বয়েসী মেয়ে আহ্লাদে লাফাতে লাফাতে তার মাকে দেখাচ্ছে, "মা মা দেখ দুর্বাসা যাচ্ছে!"   

পূর্বাশা যদি দুর্বাসা হতে পারে, রাজ থেকে রাজহাঁস কি এমন ভুল!   

তালের বড়ায় মনোনিবেশ করেছি, নতুন সমস্যার উৎপত্তি। মাতৃদেবী, মানে ছোটজন, আমার কোলে বসে বসে নিরীক্ষণ করে নাকি আবিষ্কার করেছেন, আমার একটা হাঁটু অন্যটার থেকে ছোট। আর অন্যটা নাকি এটার থেকে বড়। মানে ছোট-বড়। মানে গোলমেলে ব্যাপার আর কি!    

কিছু করার ছিল না, পিঠে নিয়ে ঘোড়া হয়ে সারা ঘর হামাগুড়ি দিয়ে প্রমাণ করতে হল যে হাঁটুরা ঠিকঠাকই আছে।   

কিন্তু প্রমাণ দাখিল করার পর উঠতে গিয়ে দেখি আর তারা ঠিক নেই। গেছে ছোটবড় হয়ে। উরি বাবা রে…     

আমার করুণ দশা দেখে তাঁর স্নেহ উদ্রেক হল। আমায় একবাটি মুড়ি এনে দিয়ে বললেন "খাও, গায়ে জোর হবে"।   

পেটে যে জায়গা খুব ছিল তা না। কিন্তু মাতৃ-আজ্ঞা, সে আজ্ঞাকারিণী যত ক্ষুদ্রাকারই হোক না কেন। একগাল খেতে না খেতেই শশব্যস্ত বাণী, "দাঁড়াও দাঁড়াও, শসা পেঁয়াজ কুচি করে রেখেছে আন্টি রান্নাঘরে, এনে দিচ্ছি।"     

ইয়ে, লাউএর ঝিরি ঝিরি ফালি আর সরু করে কুচোনো বাঁধাকপি দিয়ে মুড়ি খেতে অতি বিদঘুটে হয়, কিন্তু আমি এখন হাসিমুখে সেটা খাচ্ছি।   

খাব না? কচি কচি আঙুলগুলোর অ্যাত্তখানি ভালবাসা দিয়ে মাখা না!