একটা ঐতিহাসিক গল্প বলি আজ।
দাক্ষিণাত্যের পার্বত্য ঊষর ভূমির এক বিশেষ বৈচিত্র্য হল টেবলটপ মাউন্টেন। রক্তিমাভ
মৃত্তিকা ও কৃষ্ণপ্রস্তর নির্মিত, জলবায়ুর অদৃশ্য ছেনি হাতুড়ির যথেচ্ছ প্রয়োগে যারপরনাই
এবড়োখেবড়ো গায়ের পাহাড়গুলো বেশ খাড়া উঠে যেতে যেতে একদম আচমকা পুরো সমতল হয়ে যায় উপরটা।
যেন কেউ কচাং করে মুণ্ডু কেটে দিয়েছে।
সে একেবারে আদিগন্তবিস্তৃত সমতম ভূমি। তাতে হাঁটুর ব্যথা নিয়েও ঘরের দালানের মত
নির্বিকারে চটি ফটফটিয়ে পায়চারি করা যায়, ঘোড়ার গাড়ি চলে, ভুট্টার দোকান থেকে মুখপোড়া
হনুমান সবই বসে থাকে যে যার জায়গায়।
সেরকম এক সমতল ভূমি এখন আমার চোখের সামনে। কিন্তু নিরীহ ট্যুরিস্টদের বেড়াতে
আসার পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয় সে জায়গা। কারণ যে সময়ের কথা হচ্ছে তা কোনো সহজ
সময় নয়। দিনকাল খারাপ। যুদ্ধ চলছে। লোকে সাঙ্গপাঙ্গ ছাড়া পথে বেরোতে ভয় পায়, প্রতি
পদক্ষেপ নেওয়ার আগে খুব সাবধানে বিবেচনা করে দেখে।
এক পথিকশ্রেনী পথে এগোচ্ছে এক দু পা করে। তাদের অজান্তে, আরো একদল পথিক আসছে
এই পথেই, তবে তাদের বিপরীত দিক থেকে। মুখোমুখি হলে “কী খবর হেঁ হেঁ ভালো আছেন তো”
বলে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে, নাকি পরস্পরের টুঁটি টিপে ধরবে তা ভবিষ্যৎ-ই বলতে পারবে।
নিজেদের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে গল্প করতে করতে পথিক কজন যাচ্ছিল। এমন সময়ে খট্ খট্
শব্দে মাটি কেঁপে উঠল। এক ঘোর অসিতবরণ অশ্ব তার পৃষ্ঠে সর্বাঙ্গ কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত
আরোহী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। পথিকগণ বড় সামান্য মানুষ, সম্ভবত গরীব চাষী। মেঠো ধুতি
আর সাদাসিধে পিরাণ পরা, হাতে অস্ত্রশস্ত্রও কিছু নেই পথ হাঁটার লাঠি ছাড়া – তা দেখেই
হয়তো তাদের তুচ্ছ জ্ঞান করে অশ্বারোহী লাগাম শিথিল করে গুনগুন করে গান করতে লাগল, “কত
দূর, আর কত দূর, বলো মা!!!!”
গানের করুণরসের প্রভাবে কিঞ্চিৎ আর্দ্র হয়ে পড়েছিলুম, আবার খট্ খট্ শব্দ
পেয়ে চমকে তাকালুম। আরো দুজন অশ্বারোহী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হল। একটি আগের
জনের মতই, অন্যটি সাদা টাট্টু ঘোড়া, পিঠে বসা মানুষটিও খর্বকায় শিশুতুল্য। বয়ঃক্রম
কম বলেই হোক, বা এদিকে জায়গা বেশি ফাঁকা থাকার জন্যই হোক, এই ঘোড়সওয়ার এসেই মহা হাঙ্গামা
বাধিয়ে দিল। এদিক থেকে ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে, হুহুংকার দিয়ে, তরোয়াল আস্ফালন করে সে
এক হই হই কাণ্ড।
এরই ফাঁকে , গুটি গুটি আরো কিছু পথিক এসে হাজির হয়েছে। এরা সম্ভবত কোনো খাদানের
কর্মী, কালো মাটির গুঁড়ো এদের সর্বাঙ্গে লেপটে আছে, পোশাক শতচ্ছিন্ন ও মলিন। এরা
হাতে ছোট ছোট লগুড় নিয়ে যাচ্ছে হয়তো দেশের এই দুরবস্থা বলে, কিন্তু চোখমুখের ভাবও ঠিক
নিরীহ বলা যাচ্ছে না।
কে যে উসকানিটা দিল ঠিক বোঝা গেলো না। হয়তো শিশু অশ্বারোহীর আন্দাজের অযোগ্য
অদ্ভুত দাপাদাপিতে ভয় পেয়ে, হয়তো প্রথম অশ্বারোহীর নাতিশয় বেসুর গানে অতিষ্ঠ হয়ে,
হয়তো বা স্রেফ সময়ের দাবিতে। হঠাৎ দেখা গেল পথিক দল দুজন পরস্পরের উপর মহাবেগে ঝাঁপিয়ে
পড়েছে। এ লাঠি ঘোরায় তো ও লগুড় পেটায়। দ্যাখ না দ্যাখ পিলপিল করে আরো কতজন চলে এল
লড়াইয়ের হট্টগোল শুনে।
ঘোড়সওয়ারদের উৎসাহ দেখে কে! বলেছি কি আরো একজন শিশু, খুব সম্ভবত খুকি, হাতে
একটা বল্লম নিয়ে এসে হাজির হয়েছে ইতিমধ্যে? বল্লমটা একদা ঝুলঝাড়ুর ডান্ডা ছিল,
তাতে কী! এরকম অরাজকতার সময়ে যে যা পায় তাই নিয়ে লড়ে যায়। সে তো প্রথম অশ্বারোহীর
কোষবদ্ধ অসিটাও আসলে একদা বিছানা ঝাড়ার ঝাঁটা ছিল। বাকি দুজনের একটা আমার অফিসে
নিয়ে যাওয়ার ছাতা, অন্যটা রোল পাকানো হলুদ চার্ট পেপার।
ভুলেও ভাববেন না এসব সামান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ হয় না। ওরকম প্রবল সংগ্রাম
আপনি জীবনে দেখেননি। মুহূর্মুহু লাশ পড়ে যেতে লাগল। পথিকদের। তারাই বা ছাড়বে কেন,
বেকায়দায় পাওয়া মাত্র লগুড়ের ঘায়ে এক অশ্বারোহীকে ধরাশায়ী করে দিল।
চুপি চুপি পালাবার ধান্দা করছিলাম। নিরীহ মানুষ, এসব রক্তারক্তি ব্যাপার দেখলে
ভয় পাই। তা তাতেও বিপত্তি! আরেকটু হলেই একটা বিশাল লম্বা থাম, তার গায়ে গুচ্ছ কাদা
টাদা মাখা, তাতে মাথা ঠুকে যাচ্ছিল। এরকম নিত্যক্ষয়শীল জায়গায় আবার থাম কে বানালো ভাবতে
যাচ্ছি, কানে তালা ধরানো “প্যাঁ----“ গর্জন মাথার উপর।
হাতি!!!
তা মহারাষ্ট্রে হাতি পোষার ঐতিহ্য ছিল বইকি! যত কঠিনই মনে হোক এরকম বন্ধুর পার্বত্য
অঞ্চলে হাতি ভালই সার্ভিস দিত। পাথর দিয়ে গোদা গোদা দুর্গ, দামড়া সাইজের যমের মত ভারী
দরজা বানিয়েও রক্ষা থাকত না, হাতি দৌড়ে এসে ঐ বিপুল ভরবেগ সহ গুঁতোটি মারলেই মড়মড়
করে দরজা ভেঙে কেল্লা ফতেহ! তাইজন্য দেখবেন, পরের দিকের বানানো দুর্গগুলোর সবেতেই
দরজার বাইরে বড় বড় লোহার খোঁচা লাগানো, হাতি যাতে ধাক্কা দিতে না পারে।
কিন্তু তা বলে আমি মোটেই হাতির পায়ের তলায় চাপা পড়তে রাজি নই। ঊর্ধ্বশ্বাসে
আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে দেখি, কেস অতি গুরুচরণ। আরো দুটো হাতি সেখানে দাপিয়ে
তো বেড়াচ্ছেই, সেই সঙ্গে এসে জুটেছে দুই ভয়াল ভৈরব চেহারার যোদ্ধা। তাদের আকৃতি এত
বিশাল, গতি এতই বিচিত্র, নড়াচড়া এতই দ্রুত যে দেখলেই হৃৎকম্প হতে থাকে। তারা যে
দুই পক্ষের দুই সেনানায়ক সে আর বলে দিতে হয় না।
যুদ্ধভূমির দশা শোচনীয়। ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষুরে তার মাটি উঠে গেছে, হাতির পায়ের
চাপে স্থানে স্থানে ফাটল ধরে উচ্চাবচ, তারই মাঝে দুই সেনানায়ক উন্মত্ত গতিতে ছুটে
বেড়াচ্ছে – কার সাধ্য তাদের রাস্তায় আসে! যত দূরেই থাকুক না কেন, নজর পড়লেই ধড় থেকে মস্তক ঘচাং করে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। একটা
সুখের খবর এই যে কিছু লোক মৃতদেহগুলো কোথায় যেন নিয়ে চলে যাচ্ছে, সেগুলো অন্তত গড়াগড়ি
খেয়ে আরো সমস্যা সৃষ্টি করছে না।
কিন্তু যা হয়ে আছে তাতেই আমি ক্ষণে ক্ষণে হোঁচট খাচ্ছি। যে অল্প কজন রণক্লান্ত
পদব্রজী বেঁচে ছিল তাদের অবস্থা আরো করুণ। একজন তো একবার ভুল করে নিজের দলের
একজনকেই মেরে দিতে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে খেয়াল হল।
একপাশ ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। দুদিকে দুটো গদিওলা চেয়ারে সিনেমার নায়কের
মত দেখতে দুটো লোক কখন যেন এসে বসে আছে, তাদের দেখছি বসে বসে। দুজনেই বেশ ঝলমলে
জরি টরি দেওয়া জাব্বা জোব্বা পরা, মাথায় একজনের মুকুট, একজনের উষ্ণীষ। ও, এটা
তাহলে সিনেমার শুটিং হচ্ছে নির্ঘাৎ! আরেকটু আড়াল দেখে ঘাপটি মেরে বসি – না মানে চেহারাটা
তো নেহাৎ ফ্যালনা নয় আমার, অসহায়া বন্দিনীর রোলে প্লে করতে ধরে নিয়ে যায় যদি –
আহা, মহারাষ্ট্রে ভোজপুরী সিনেমার শ্যুটিং হবে না এমন কোনো কথা আছে কি!
এমন সময়ে...
নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। গাঁজা টাজা খাইনা বলেই তো জানতুম। তাহলে দূর
দিগন্তে একটা আস্ত কালো পাথরের গম্বুজওয়ালা দুর্গ হেলে দুলে কদম কদম এগিয়ে আসছে
কেন হে! সেই ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’ কেস হল কেমন করে রে বাপু! এর পর কি সিংহগড়
বা শনিওয়ার ওয়াড়াও ‘লক অ্যাণ্ড কী’ খেলতে খেলতে চলে আসবে নাকি!
প্রবল চীৎকারে কাছের দিকে নজর ফেরাতে বাধ্য হলুম। অঘটন ঘটে গেছে সেখানে,
অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে, এক সামান্য পদাতিক শুভ্রবাসাবৃত সেনানায়ককে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে।
সে শুয়ে শুয়ে “আই মাই ঘড্” করে চিল্লাচ্ছে আর ফোঁপাচ্ছে।
এর পর হুট করে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। সেই অপ্রাকৃত ভ্রাম্যমান দুর্গের সহায়তায়,
অন্য সেনানায়ক লাল মুকুট পরা হিরোটিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নিয়ে উল্লাস করতে করতে
চলে গেল। বাকি সবাইও তার পিছন পিছন উধাও হল।
[বুঝে গেছেন নিশ্চয় এতক্ষণে? তিতির আর তার দাদুমণি দাবা খেলছিল।]