বহু কষ্টে বিদ্যাটি আয়ত্ত করছিলুম জানেন! এমনি এমনি নয়, একটা আস্ত আখাম্বা চারতলা
প্রাসাদোপম বাড়ি বানানোকে কেউ এমনি এমনি কাজ বললে তার কানে গুজিয়ার প্যাঁচ মেরে গায়ের
উপর
আঠেরো পিস বুভুক্ষু ছারপোকা ছেড়ে দেব বলে দিলুম!
সে কি যে সে বাড়ি! সে বাড়ির একতলায় আছে ‘প্রাসাদোপম’ ( শব্দটা বলে ফেলে মহা ভুল
করেছি! সব কিছুতেই এই বিশেষণটা না লাগালে, তিনি গোঁসা হচ্ছেন।) “বাথথুম্”।
প্রচুর আপত্তি করেছিলুম জানেন। এটা মেনে নেওয়া যায়? বাড়িতে ঢুকেই “বাথথুম”! মানে,
কল্পনা করুন, আপনি বন্ধুর বাড়ি গেলেন, বেল বাজালেন, হাসিমুখে বন্ধু এসে দরজা খুলল,
আপনি ভিতরে ঢুকেই হয় বাথটাব নয় কমোডে গুঁতো খেলেন? এরকম বাসায় ঢুকেই গোসলখানায় পদার্পণ
করতে লোকে গোঁসা হবে না?!
তা আর্কিটেক্ট পাত্তাই দিল না। ওটাই নাকি তার ডিজাইন।
সুতরাং হল বাথথুম। সত্যিকারের জল ভরা বাথটাব দিয়ে। (ফোঁস! ঐ বাক্সটায় চুলের ক্লিপগুলো রাখতুম,
সেগুলো আর বাক্সের ঢাকনা কোথায় গেল পরে খুঁজতে হবে আবার!)
তার উপরতলায় খাবার ঘর। কুট্টি কুট্টি কাঠের টেবিল চেয়ার, গত জন্মদিনে কিনে দিয়েছিলুম।
তার উপরে একটা ধুমসো কেকের শেপের মোমবাতি – জ্বালা হবে, না খাওয়া হবে তা নিয়ে অনেকক্ষণ
অবধি দ্বিমত চলছিল, শেষমেশ ঠিক হয়েছে দিনের বেলা খাওয়া হবে আর সন্ধেবেলা জ্বালা
হবে। কে বলেছে you cannot eat your cake and have
too!
খাবার ঘরে একটা পিঙ্ক বাহারি আলমারি রাখা হয়েছে। ওটা দরকার মত ফ্রিজ, ওভেন বা খাবার
তুলে রাখার র্যাক ভেবে নিতে হবে। এসব সামান্য অ্যাডযাস্টমেন্ট যদি না পারেন তো খেলতে
আসেন কেন মশাই! দেখুন, দেখে শিখুন। এইমাত্র আমি আলমারি (ফ্রিজ) থেকে পাস্তা বার করে,
আলমারিতে (ওভেনে) গরম করে আলমারিতে (র্যাকে) তুলে রাখলুম। অবশ্য র্যাক থেকে নামানোর
সময় ওটা পাস্তা থেকে খিচুড়িও হয়ে যেতে পারে। সে যাক!
উপরে চলুন। তিনতলা হচ্ছে শোবার ঘর। খাট, বিছানা, দুটো অতি নয়নমনোহর বাহারী ‘পাপ্পল কালারের’
সোফা্, একটা ততোধিক বাহারি গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, একটা হেলে পড়া নারকেল গাছ।
চমকানো নিষিদ্ধ।
ওটাই আর্কিটেক্টের ডিজাইন।
কে বলেছে এমন হয় না? এককালে ‘ওরাকল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস’এ কাজ করতুম।
গোরেগাঁওতে তাদের অফিস বিল্ডিং-এর মাঝামাঝি একটা ফ্লোর ওপেন,গুচ্ছের এইরকম চমৎকার পাম গাছ টাছ আছে। এখনো আছে, ওদিক
দিয়ে গেলে দেখতে পাই। তা, অফিস লবিতে যদি হতে পারে, বাড়ির শোবার ঘরেই বা না হবে
কেন বাপু!
তবে, ঘুমোতে ঘুমোতে মাথায় যদি নারকেল খসে পড়ে, এই বলে আমি একটু ক্যাঁওম্যাও
করেছিলুম। তিনি ভারি নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, এটার নারকেল খসে পড়ে না, কেটে পাড়তে হয়।
হবেও বা। আর কথা বাড়াইনি, যা মেয়ে, বেশি বললে হয়তো গাছের ডগায় ফেভিকল মাখিয়ে
বসে থাকবে। তারপর সে প্লাস্টিকের নারকেল গাছ আমার ড্রেসিং টেবিলে জন্মের শোধ আটকে যাবে...থাক তার চেয়ে!
এই অবধি খাসা চলছিল বুঝলেন। তিনি হুকুম করছেন হাত পা নেড়ে আর আমি স্যাটাস্যাট মালপত্তর
ফিট করছি। আর একটাই তলা বাকি ছিল , চারতলা, টপ ফ্লোর।
“এটা।“
হাতে নিয়ে মুহ্যমান হয়ে থাকি একটু। প্লাস্টিকের গাছে ল্যাজঝোলা পাখি, আসলে ফ্রুট
ফর্কের সেট। ভারি শখ করে হাতিবাগান থেকে কিনেছিলুম। হাতে গোনা কয়েকদিন খাবার টেবিলে
থাকার পর আশ্চর্যজনক ভাবে গাছটা উধাও হয়ে যাওয়ার পর, খুব স্বাভাবিকভাবেই পাখিগুলো কন্যার
খেলনার ঝুড়িতে ঠাঁই পেয়েছিল। এদ্দিন পরে আমার হাতে আবার সেই গাছটা!
“আরে, রাখো ওটা? উঁহু উঁহু ওদিকে না, এদিকের দেওয়ালে , এই এই এইরকম করে।“
প্রায় আমার ভুঁড়ি বেয়ে উঠে সেটা ঠিক করে সেট করা হল।
আমি ভাবছি এবার পাখি বসবে বুঝে ডালে ডালে। ওমা, একটা ধুমসো লাল গাড়ি হাতে ধরিয়ে
দিল।
“রাখো?”
“ইকী! গাড়ি এত উপরে থাকে না! ইকী! না না…”
কে শোনে কার কথা। ওইটেই নাকি গ্যারেজ। ওখানেই গাড়ি রাখতে হবে।
“নামবে কী করে? রাস্তায় চলতে হবে তো!”
“আহ মা! ব্যাট্মোবাইল দ্যাখোনি? এই তো এইরকম ডানা খুলবে (গাড়িটা দরজা খোলা যায়
দেখে আমিই কিনেছিলুম বটে) আর হুশ্ করে উড়ে যাবে!”
যাক তবে। উড়েই যাক। আমার এমনিতেই হুঁশ
উড়ে যাচ্ছে। কথা না বাড়িয়ে গাড়ি রেখে দিই।
তারপর দুজনের একসঙ্গে খেয়াল হয়।
“ও মা, সিঁড়ি?”
“এই, উঠবে কী করে?”
এগিয়ে পিছিয়ে, এদিক ওদিক থেকে মন
দিয়ে অবলোকন করি। না, সিঁড়ি বলে চালানোর মত কিছু চোখে পড়ে না।
তারপর মাথায় বুদ্ধি আসে। দুটো খালি কৌটো, একফালি লম্বা উলের দড়ি, দুটো রাবার
ব্যান্ড।
নে, তুই আমায় ব্যাটমোবাইল দেখাচ্ছিস, আমি তোকে অরণ্যদেবের গাছবাড়ির ঝুড়ি লিফট
করে দেখালুম। এবার লিফটে চেপে যত খুশি ওঠানামা করা পুতুলদের।
এইবার, আমাদের বাড়ি কিন্তু রেডি!! হেব্বি হয়েছে, যাই বলো! বাড়ির বাসিন্দা দুই
ঝুঁটিবাঁধা কুট্টি কুট্টি পুতুলও এসে গেছে! তবে তারা এবার জামা টামা খুলে বাথটাবে
‘চাং’ করবে, তোমরা ধেড়েরা এখন এখান থেকে যাও দিকি!