Sunday, 16 August 2020

লেখাপড়া

 

কান থেকে পট করে ইয়ারফোন খুলে চলে গেল। তারপর ফোনটাও গেল বেহাত হয়ে। ‘হি হি হি’ করতে করতে একটা ‘মোটেই আর ছোট নয় কিন্তু আসলে এক্কেবারে ছোট্ট ছানা’ মেয়ে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।

দুপুরে খেয়েদেয়ে উঠে, নিজের চেয়ারে বাবু হয়ে চড়ে বসে ল্যাপটপে টরেটক্কা করছিলুম। ছুটির দিনেও আপিশের কাজ করানোর জন্য মনে মনে বসকে কী কী সুভাষিতাবলী বর্ষণ করছিলুম সে আর নাহয় না-ই বললুম!

তাহলে কানে ইয়ে এল কোথথেকে? কিছুই না, ব্যাকগ্রাউন্ডে একটু সঙ্গীতচর্চা হচ্ছিল। মন ভালো রাখার চেষ্টা।

কথা হচ্ছে, এমনি করে চুক্কি দিয়ে পালাবে, আর আমি ছেড়ে দেব? ইয়ার্কি পায়া? অতএব ম্যাক্সি গাছকোমর করে (হ্যাঁ, হ্যাঁ, করা যায় কীভাবে যেন। মানে করতে পারি, কিন্তু বলে বোঝাতে পারব না) ধাঁই করে আম্মো দৌড়লুম পুঁচকেপানাটার পিছনে। প্রচুর কসরৎ সহযোগে, এ দরজা দিয়ে ঢুকে ও দরজা দিয়ে বেরিয়ে, এই ধরি এই ধরি এই ফসকে পালাল – এসবের পর ধরে ফেললুম খপ্‌ করে।

প্রচুর কিলবিলিনির পর রফা হল, আমি যদি কাজ ছেড়ে উঠে আসি, তাহলে আমার কাছে বসে এক রাউন্ড পড়া করতে হবে আগে, তারপর মঈশাসুরের গল্প পাওয়া যাবে।

সেইমত বইখাতা নিয়ে ঘটা করে বসা হল খাটে।

নামতার আমতা-আমতা পেরিয়ে, দাঁত খিঁচোনোর পালা শেষ করে (আজ্ঞে না। মোটেই বকাবকি করিনি। সায়েন্সে ‘দাঁত’ চ্যাপ্টার পড়ছিল, তাই বার বার আমায় হাঁ করিয়ে কোনটা মোলার, কোনটা প্রিমোলার এসবের প্র্যাকটিকাল ক্লাস করছিল।), হিন্দির বিপরীতার্থক শব্দে হাবুডুবু খেয়ে (গুগল না থাকলে কী যে করতুম আমার অনন্যসাধারণ হিন্দিজ্ঞান নিয়ে!) অবশেষে টেন্সড হওয়া গেল।

মানে ইংলিশ বই খুলে টেন্স পড়া শুরু হল আর কী!

সে এক ভয়ানক জগঝম্প ব্যাপার, যারা জানে না তাদের আগেই বলে রাখি। পাস্ট প্রেজেন্ট ফিউচার, আবার তাদের প্রত্যেকের কন্টিনিউয়াস আলাদা করে। বোঝাচ্ছি, উদাহরণ দিচ্ছি, পড়া ধরছি, তারপর গুলিয়ে ফেলেছে দেখে আবার শুরু থেকে শুরু করছি। লুপে চলল এই খানিকক্ষণ। আমার মাথায় এদিকে ‘সবই মায়া, কী বা সময়, কী বা আজ আর কী বা কাল, কাকে বলে অতীত আর কাকেই বা বলে ভবিষ্যৎ, কারণ, ওই, সবই মায়া...” ইত্যাদি বেজে চলেছে। ফলে এবার নিজেও মাঝে মধ্যে গুলিয়ে ফেলার উপক্রম করছি।

অগত্যা স্ট্র্যাটেজি পালটানো হল।

একটাই বাক্য ধরে তাকে একবার পাস্টে ফেলা হবে, একবার ফিউচারে, তারপর সেগুলোকে কন্টিনিউয়াস করে ফেলা হবে। ইট’স আ গেম, য়্যু নো!

গেমটা কিন্তু হেব্বি জমে গেছিল!

“আই ঈট পাস্তা।”

“আই এট পাস্তা।”

“আই শ্যাল ইট পাস্তা টুমরো এগেইন!”

“এই না মোটেই রোজ রোজ পাস্তা বানিয়ে দেব না আমি! এটা বল - দে গো টু স্কুল।”

“দে ওয়েন্ট টু স্কুল। কিন্তু সে তো বাজে কথা, মোটেই যায়নি, কাল তো স্কুল ছুটি ছিল!”

“আহা পাস্ট মানে গতকালই হতে হবে কে বলেছে! গত সপ্তাহে গেছিল, গত বছর গেছিল…”

এইভাবে দিব্য চলছিল। গোল করলুম একটু আরো মনোহর করতে ডাইনোসর এনে।

“বল দিকি - টেরোডাকটিলস কুড ফ্লাই।”

ব্যস, মেয়ে আর কিছুতেই তার প্রেজেন্ট বা ফিউচার করবে না! কারণ ডাইনোসর তো কবেই উল্কা পড়ে মরে গেছে, বললেই হল তাদের প্রেজেন্ট আর ফিউচার!

আমার তুম্বোমুখ দেখে তার কী মনে হল কে জানে, ফিক্‌ করে হেসে বলল, “অনেকক্ষণ আমি করেছি, এবার তুমি করো দেখি!”

দিবি? তা দে! আমি কি ডরাই সখি… ইত্যাদি প্রভৃতি…

“এমন একটা দেব না… সেটার পাস্ট, প্রেজেন্ট, প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস, ফিউচার সব হয়। সঅঅঅব”

আচ্ছা! মানে সূর্যদিকে পুবদিকে ওঠে টাইপের কিছু একটা বলবে আর কী! তা বল!

মেয়ে দেখি ফিক ফিক করে ফিচেল হাসে খালি।

তারপর দিল এই মোক্ষম একখানা সেন্টেন্স।

“তিতির ঈটস মাম্মা’স হেড!”

বইপত্তর গুছিয়ে তুলে তৎক্ষণাৎ ছুটি দিয়ে দিলুম, মশাই!

 

Sunday, 2 August 2020

সুপারহিরো

 
ছ্যাঁক্ ছোঁক্ করে আওয়াজ আসছে রান্নাঘর থেকে। রোব্বারের বেলা, বেশ কদিনের বিষ্টিবাদল পেরিয়ে আজ আকাশে ফুটফুটে আলো। নাক উঁচু করে  ঢ্যাঁড়শভাজার মনোহর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কন্যা লাফাতে লাফাতে রান্নাঘরে এসে হাজির।

"মাঁ! কীঁ কর্ছো!"

মা জানে, এটা প্রশ্ন নয়। মায়ের চুড়ো খোঁপা, কপালে বিনবিনে ঘাম, হাতে উদ্যত খুন্তি, জ্বলন্ত গ্যাস - এসবের মানে যে মা রান্না করছে, সেটা না বোঝার মত শিশু তিতির নয় আর। দেখতে দেখতে এই করোনাকালেই প্রোমোশন হয়ে ক্লাস ফোর, প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ অভিজ্ঞ মানুষ তিনি একজন। তাঁকে এদ্দূর তুলে আনতে গিয়ে এই খুন্তিধারিনীও একজন প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ মা হয়েছেন বইকি, তাই দ্রুত হাতে গ্যাস নিভিয়ে কড়াই থেকে রান্না পদার্থ পাত্রে ঢালতে ঢালতে অপেক্ষা করেন, আসল বক্তব্যের জন্য।

পরক্ষণেই সেটা শোনাও যায়, "মা! আমার সঙ্গে খ্যাঁলোঁ না!"

আজ আমার মুডটা অবিশ্বাস্য রকমের ভালো ছিল। তাই বলামাত্র রাজি হয়ে গেলুম,  "আচ্ছা চ'। কী খেলব?"

আহ্লাদে মেয়ে চারপাক নেচে এল। তারপর হাততালি দিয়ে বলল, "আমি জানি! আমরা হব... সুপারহিরো টীম!"

বেশ বেশ! অত্যুত্তম প্রস্তাব।

একটু পর। 

তিতির কীসব ব্যবস্থা করতে গেছে। আমি খাটে বসে পা দোলাচ্ছি আর খেলার পরবর্তী ধাপের অপেক্ষা করছি। তিতিরের সবেগে প্রবেশ।

"মাম্মা! পিঙ্কি টেডি হারিয়ে গেছে, রেস্ক্যু করতে যেতে হবে, চলো চলো চলো!"

রেস্ক্যু মিশন! 

তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে দুই সদস্যের টীম চলল। কই গেলি রে ছোট্ট মিষ্টি পিঙ্কি টেডি? খাটের নিচে, টেবিলের পিছনে, বালিশের তলায়...

এঘর ওঘর খুঁজে বাইরের ঘরে এসেই আমি হইহই করে উঠেছি। ওই তো টেডি! জানলার পর্দায় ক্লিপ দিয়ে ঝুলছে। একদম আমার চোখ বরাবর…!

"পাইয়াছি রে পাইয়াছি! পিঙ্কি টেডি! আর ভয় নেই, এই দ্যাখ আমরা এসে গেছি!"

কলরব করে ক্লিপ খুলে টেডিকে কোলে করে নিয়ে আসি। 

একী!

তিতিরের মুখ গম্ভীর। চোখ ছলোছলো। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় অভিযোগ, "তুমি কেন আনলে?"

আমি তো থ! 
"কেন, কী হয়েছে?"

"রেস্ক্যু তো সুপারহিরো করবে!"

আমি আরো হতভম্ব, "তাই তো রেস্ক্যু করলুম! এই যে বললি আমরা সুপারহিরো টীম!"

নাক টানতে টানতে উত্তর এল, "টীমই তো! আমি সুপারহিরো, আর তুমি আমার সাইডকিক্।"

...!!!

আর যদি কখনো জব ডেস্ক্রিপশন না জেনে কাজে যোগ দিয়েছি!