Tuesday 23 February 2021

মায়ের ছা



আরেকটু হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তুম!

হয়েছে কী, আপিশের দিন তো, বাবু হয়ে চেয়ার চড়ে বসে কোডসাহারায় এক বেয়াড়া বাগের পশ্চাদ্ধাবন করছিলুম, তালেগোলে মিটিং-এর টাইম হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। একসঙ্গে চারটে চ্যাটবক্সে এবং ফোনে ডাকাডাকি শুরু হতে হুঁশ ফিরল।

তখন হুড়মুড় করে কানে চটি… আরে ধ্যাৎ! তাড়ার চোটে পা নামিয়ে চটি পাই না, ফোনের সুতো কানে গুঁজতে গিয়ে ডান-বাঁ ঘেঁটে যায়, মিটিং-এর পাসওয়ার্ড খুঁজে পাই না…তারপর “অ্যাম হিয়ার, অ্যাম হিয়ার…” বলতে বলতে সবেগে ছাতের দরজা খুলে বেরিয়েই রামধাক্কা।

ছাতে কেন? নইলে শোনা যায় না পষ্ট।

আর ধাক্কা কেন?

কে জানবে রে ভাই, দরজার ঠিক পাশটিতে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমার সদাচঞ্চলা কন্যা এই ঠা ঠা রোদ্দুরে কাক-পায়রাকে দানা খাওয়াচ্ছে!

ভুঁড়িতে তার মুণ্ডুর গুঁতো সামলে, দম ফিরতে চেয়ে দেখি, তিনি হাওয়া, আর আমার চারদিকে একপাল মারমুখো কাক-পায়রা ক্যাঁচম্যাচ করছে। মানে, সিচুয়েশনের তিতির নামল নিচে, আর হাতে রইল আমার জন্য “হ্যালো হ্যালো” করে হাল ছেড়ে দেওয়া কনফারেন্স কল!

বেশ খানিক পরে, এসব মিটে টিটে যাওয়ার পর আবার নিজের চেয়ারটিতে শান্তিতে বাগিয়ে বসেছি, লুকোনো কৌটোয় আপাতত ঝাল-ঝাল চানাচুর আছে সেও একটা বেশ ভালো কথা… দরজার কাছে একটা হাসিমুখ উঁকি মারল।

আমি তাকাতেই টুক করে পালিয়েও গেল।

তারও আরও একটু পরে, কচি কচি দুটো হাত পিছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল।

“ম্যাঁ!”

“বলে ফ্যাল!”

“এটা আমার মা!”

“সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও কারণ ঘটেছে কি?’

“এঁ… বেশি লাগেনি তো?”

এইখানে মায়ের বেজায় হাসি পেয়ে যাওয়ায় মুখটা আর গলাটা বিকট গম্ভীর হয়ে গেছিল।

“তা না হয় বেশি না লাগল, কিন্তু তুই অমন যখন তখন ওদের খাওয়াস না। সকালে দিয়েছিস তো সবাইকে!”

“এট্টুই দিয়েছি মা এবার…”

“অসুখ করে যেতে পারে। ওদেরও বেশি বেশি খেলে, তোরও অমন কড়া রোদ গায়ে লাগালে…”

“আই ওয়াজ হ্যাপিয়েটিং মাইসেলফ!”

“ক্কীঈঈঈ?”

সেই ‘পপাত চ’ কাণ্ডের পর রিভল্ভিং চেয়ারটায় আমি আর বসি না। ফলে নিজেই ঘুরে বসলুম।

“কী বললি?”

“আই ওয়াজ হ্যাপিয়েটিং মাইসেলফ! অ্যান্ড দেম!”

নিজে থেকেই চোখটা ডানদিকের বইয়ের আলমারির দু নম্বর তাকে যেখানে ‘মধুসূদন রচনাবলী’ রাখা আছে সেখানে চলে গেল।

হ্যাঁ রে? আমি শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসি বলে তুই আমায় ইংলিশে নামধাতু তৈরি করে ঘায়েল করবি? এ তো গুরুমারা বিদ্যে হয়ে যাচ্ছে হে!

বললে পেত্যয় যাবেন না, সেদিনই বিকেলে আবার কী হল!

আমি তখনও যথারীতি ল্যাপটপনিবিষ্ট আপিশবিহারিণী। তিতিরের স্কুল শেষ, সে পাশে খাটে খেলনাপাতি ছড়িয়ে খেলছে। পিঠ টান করতে গিয়ে মাথায় বিচ্ছুবুদ্ধি এল, বেশ মখমলি গলায় হাঁকডাক শুরু করলুম, “তিতির! ও তিতির!”

সরু গলায় উত্তর এল, “এইত্তো!”

কিছুই শুনতে পাইনি, এমন ভাব করে আরেকটু গলা চড়ালুম, “তিতির? তিতিরপাখি? কই গেলি?”

এবার মেয়ে মুখ তুলে হাঁ করে আমার দিকে চাইল, তারপর উঠে এসে গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে সাড়া দিল, “আরে, এইতো আমি! এই যে দেখো!”

আমি বেজায় হাসি চেপে, সোজা ওর দিকে তাকিয়ে আবার ডাকতে লাগলুম, “তিতির! ডাকছি যে! সাড়া দিচ্ছিস না কেন! ওরে আমার তিতিরপাখি, আয় রে!”

চশমার ফাঁক দিয়ে গোল গোল চোখ করে আমায় দেখছে, আমার মনের মধ্যে কুলকুল করে হাসি বইছে, এইবার খেল খতম করে জড়িয়ে ধরব, দুম করে মেয়ে ছিটকে সরে গেল।

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, ভারি গ্রাম্ভারি চালে সটান আমার দিকে চেয়ে তারসপ্তকে চেঁচাতে লাগল, “মা! ও মা! ও তিতিরের মা! কই গেলে? দেখতে পাচ্ছি না কেন?”

তারপর ভ্যাবাচ্যাকা মায়ের দিকে চেয়ে, ফিক করে হেসে দুড়দাড় সিঁড়ি দিয়ে পালাল পুঁচকেপানাটা।

খানিক ভ্যাবলা হয়ে বসে রইলুম। তারপর উঠলুম। লুকোনো চানাচুরের কৌটোর পাশেই কন্যার লুকোনো পায়রার দানাসমূহর কৌটো থাকে। তার থেকে একমুঠো নিয়ে গুটি গুটি ছাতের দিকে চললুম।

যাই, একটু ‘হ্যাপিয়েটিং’ করে আসি! 

Wednesday 17 February 2021

সরস্বতী পুজো

 


ছোট্ট
দুটো গল্প শোনাই।

 

কন্যা আজন্ম মুম্বইয়ের বাসিন্দা, কিন্তু তাঁর মা কুড়ি বছরেরও বেশি প্রবাসে কাটিয়ে ফেলেও নিজেকে "কলকাতার মেয়ে" বলেন। ফলে তিতির যেমন "আমচি মুম্বই" নিয়ে গর্বিত, তেমনই আনন্দিত নিজেকে "ব্যাঙ্গলি" বলতে। এবার, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর স্কুলে শেখানো ভাষাগুলি হল ইংলিশ, হিন্দি মারাঠি। ফলে বাংলাশিক্ষা চর্চা বাড়িতে যেটুকু ভালোবেসে করা সম্ভব, সেটুকুই।

 

এরকম একদিন সন্ধ্যায়, আমি আপিশ করছি, পাশে সদ্য পছন্দ করে কেনা একটা গল্পের বই নিয়ে মেয়ে বসেছে পড়তে। নিজেই পড়ছে, মানে আটকালে বলে বলে দিচ্ছি। খানিক পর সেসব তুলে রেখে খেলছে, খেলতে খেলতে গল্প চলছে। বইতে পড়া অংশ নিয়েও কথা হচ্ছে।

 

"মা আরেকটা কী যেন টাইপ ছিল পায়রার?"

 

এটা ওটা বলি।

 

"না, না। বিদ্যুৎ! "

 

ট্যান খাই। জন্মে পায়রার টাইপ বিদ্যুৎ হতে শুনিনি। সেরকম শুনতে কোনো শব্দ? মনে হাতড়াই। পাই না।

 

"হ্যাঁ গো। বিদ্যুৎ...  কী একটা ছিল! পায়রা!"

 

অগত্যা বই খুলি দুজনে।

 

"এইত্তো! এটাই বলছিলুম!"

 

তারপর আমার দিকে চেয়ে লাজুক হেসে, "বিদ্যুৎ চমকালে বাজ পড়ে না?"

 

এবার থেকে "গেরোবাজ" পায়রা দেখলেই আমি বিদ্যুৎ বলে ডাকব।

 

---

 

অনেকদিন বিচ্ছিরিভাবে কাজের চাপে ফেঁসে আছি। কত কিছু করতে ইচ্ছে হয়, করতে পারি না। সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল থেকে মাইকে "কোথা আছো গুরুদেএএএএব" ভেসে আসতে শুনে খুব কাগজ কলমে ছবি আঁকতে ইচ্ছে হল। ছোটোবেলার নস্টালজিয়া আর কী!

 

কালো জেল পেন একটা আছে, কিন্তু আর কিছু নেই। তিতিরের কাছ থেকে ড্রয়িং খাতা, পেন্সিল ইরেজার ধার নিয়েই বসে পড়লুম অগত্যা।

 

হাত একেবারেই গেছে বুঝতে পারছি। তবু ঠাকরুণকে মনের মতো করতে পারলুম অনেকটাই। তাপ্পর একটা কফি ব্রেক নিলুম।

 

ছাতে হাওয়া খাচ্ছিলুম। তাঁর আগমন।

 

"ম্যাঁ? তুমি হাঁস আঁকতে ভুলে গেছো?"

 

অকপটে স্বীকার করি, হাঁসটা আমি ঠিক পারছি না বলে বাদ দেব ভাবছি।

 

"আমি এঁকে দেব?"

 

এক সেকেন্ড লাগে আমার দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে।

 

"দে না! খুব ভালো হবে।"

 

যেতে গিয়েও দেখি ইতস্তত করছে। "বলছি... থাক। যদি ভালো না হয়...?"

 

" আবার কেমন কথা, তিতির? যেমন ইচ্ছে করছে আঁক, মন দিয়ে কর, অফ কোর্স ভালো হবে।"

 

"যদি ছবিটা খারাপ হয়ে যায়? তুমি অত সুন্দর করে এঁকেছো..."

 

"গেলে যাবে। আবার এঁকে দেব। যা, কর। নিজের নাম সই করে দিবি, আমি যেমন করি দেখেছিস তো?"

 

ঘাড় কাত করে একদৌড়ে চলে গেল।

 

আরও খানিক পরে, ঘরে এসে দেখলুম আমার  সরস্বতী ঠাকরুণের পাশে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাঁসের ছানা ডানা ঝাপটাচ্ছে।

 

এই না হলে আমার বিএফএফ!

 

এই- আমাদের সরস্বতী পুজো, বুঝলেন। বইতে, ছবিতে, গল্পে। একদিন নয়, প্রতিদিন, বছরভর।

Saturday 9 January 2021

পিজিনিস্তা

 


পিজিনিস্তা…”

রিনরিনে গলার ডাকটা রোদমাখা শীতের সকালে ছড়িয়ে যায়। কাজ করতে করতে চোখ সরিয়ে তাকাই। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে হুড়মুড় করে ওরা এসে গেছে, দেখতে পাই।

ওরা পাঁচজন।

পিজিনিস্তা, পাঈরা-পাঈরা, পিগলু, হ্যারি আর কাগলা।

আমিও ছাতের রেলিং-এর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, তিতিরের হাত থেকে ছোট্টো ছোট্টো পাউরুটির টুকরো গিয়ে পড়ছে নিচের জানলার উপরের কার্নিশে। হুটোপুটি করে খাচ্ছে দুটো কালো, একটা ছিটছিটে আর একটা সাদা পায়রা। ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতি করছে নিজেদের মধ্যে, ভাবগতিক দেখে পষ্ট শুনতে পাই “অমন খোঁচাস কেন মুখপুড়ী!” “সব বড় টুকরো একাই খাচ্ছিস কোন আক্কেলে” মার্কা বকবকম।

পঞ্চমজন কিন্তু ঐখানে আসে না। নিমগাছের ডালে বসে কড়া চোখে সব জরিপ করেন শ্রীমান কাগলা কাগা। তিনি আবার তিতির ঠাকুরানীকে বেশ একটু সন্দিগ্ধ চোখে দেখেন, সে ছাত না ছাড়া অবধি তিনি ভোজনে নামবেন না।

অবশ্য বেচারার দোষও নেই। প্রথম দিন খেয়েদেয়ে ওই নিমগাছের নিভৃতিতেই তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এদিকে তিতির ঠাকুরানীর মনে যে হঠাৎ বইতে লেখা কাক ঝাড়ুদার পক্ষী, এঁটোকাঁটা খায় এসব চাগিয়ে উঠেছে তিনি আর কী করে জানবেন! ঠাকুরানী মায়াপরবশ হয়ে ছাতে জল দেবার পাইপ দিয়ে ‘আহা! নোংরা, চান করতে পায় না” কাগলাকে দিয়েছেন কষে ধুইয়ে! আঁকপাক করে সেই যে উড়াল দিয়েছিলেন, সেই থেকে তিতিরকে ভারি সন্দেহের চোখে দেখেন কাগলাবাবু।

দিকে পাউরুটি শেষ (কাগের ভাগ আলাদা আছে), পিজিনিস্তারা তবু হাঁ করে উপরে চেয়ে আছে। তিতিরও প্রায় একইরকম জুলজুলে চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে দেখে অগত্যা বললুম, যা মুড়ি নিয়ে আয়।

(নোট – বিকেলে মুড়ি আনতে হবে। আধকৌটো তো একদিনে সাবাড় করে দিল!)

মুড়ি ছড়াতে ছড়াতে তিতির উলটো দিকে বাড়ির জানলার কার্নিশের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটা টুথব্রাশ পড়ে আছে। গেছে হয়তো কারও হাত থেকে পড়ে।

“ঐটে পিজিনিস্তাদের বুরুশ, বুঝলে?”

“অ্যাঁ?”

“ঐটেতে পায়রারা দাঁত ব্রাশ করে সকালে, তারপর খেতে আসে। দাদুমণি বলেছে।“

বুঝে নিই। দাদুমণির আজগুবি গল্পের জগৎটা তো আমারও ভারি চেনা! তবু সন্দেহ প্রকাশ করি,

“ভাগ্‌! ওদের দাঁতই তো নেই, দাঁত মাজবে আবার কী!”

ভারি গম্ভীর মুখে চশমাটা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে তিতির বলে,

“দাঁত নেই তো কী! ঠোঁট মাজে। তোমার ঠোঁট ওদের মত শক্ত হলে বুঝতে।“

বলে তিড়িং তিড়িং করে নিচে চলে যায়।

আরেকটু দাঁড়িয়ে ছিলাম আপনমনে, হঠাৎ খেয়াল হল কাগলা ছাতে নেমে এসেছে, তার বরাদ্দ পাউরুটি ঠুকে ঠুকে খাচ্ছে। আমায় দেখেই গলা বাড়িয়ে নিচের দিকে কী যেন দেখাল।

আমি আবার উঁকি মেরে দেখি, পিজিনিস্তা সেই পড়ে থাকা টুথব্রাশে ঘষে ঘষে ঠোঁট মুছছে, আর সবার ছোটো পায়রাটা, হ্যারি, পাশের কার্নিশে ঠোঁট বাগিয়ে বসে আছে...যেন বাথরুম  খালি হলেই ঢুকবে!

বেকুব হয়ে আবার কাগলার দিকেই তাকালুম। সে খেয়েদেয়ে উড়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমার চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন চোখ মটকে বলল, “ক্কঃ!”

সব কেমন গুলিয়ে গেল, বুঝলেন! এবার ঘরে ফিরে গিয়ে যদি দেখি ল্যাপটপটা আড়মোড়া ভেঙে ‘ম্যাও’ বলছে... কিছুই আশ্চর্য হব না!

 

 

Saturday 2 January 2021

রান্নাবাটি



রান্নাবাটি খেলতে বসেছে মেয়ে। তার কচি হাতের খুন্তি নাড়ার টুংটাং ডেকে এনেছে তার মাকেও।

"অ তিতির? আমায় খেলতে নিবি?"

"হুঁ! তুমি আমার জোগাড়ে হও।"

পূর্বস্মৃতি মাকে বহুল বিচক্ষণ ও সতর্ক করে তুলেছে। তিনি জব ডেস্ক্রিপশন চেক করে নেন, "আমাকেও রান্না করতে দিবি তো? খালি কুটনো কোটা আর বাসন মাজা করাবি না তো?"

কন্যা দয়ার অবতার হয়ে অভয় দেন, হবে হবে, তোমাকেও এক রাউন্ড ব্যাটিং দেওয়া হবে।

মা সুতরাং মাটিতে ধুপ করে বসে পড়েন। ভালো সময়ে জয়েন করা গেছে। রান্নাঘর সাজানো চলছিল। হাতে হাতে লাগিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে বাঁদিকটা পটাপট গুছিয়ে ফেলেন তিনি। 

"ওটা কী হল? ম্যাঁ?"

মেয়ে ছাগলছানার মত ডাক পাড়া মানেই গণ্ডগোল। মা চোখ পাকিয়ে অবলোকন করেন কোথায় কী ছড়িয়েছেন। অ্যাই যাঃ! বালতিটাও ভুল করে গ্লাসের মধ্যে রেখে ফেলেছেন যে র‍্যা! নে বাবা তোর বালতি।

ইকী! হাঁড়ি পাতিলের পাশে প্যাঁচা, ঘন্টা এসব কেন?

"আরে লাগে! তুমি জানো না! ঘন্টা বাজিয়ে খেতে ডাকতে হয়!"

অ, বিলিতি কেতা! তা এসব হাঁড়িকুড়ি খুন্তি সাঁড়াশি  শোভিত রান্নাঘরে রান্না করে তুমি যে ডিনারের গং বাজিয়ে খেতে ডাকবে সে আমি কেমন করে জানব! তাও কিনা ওই ছাগলের গলায় বাঁধা ঘন্টা দিয়ে! 

যাকগে, রাঁধুনির মর্জি। কিন্তু প্যাঁচা কেন বাপু? ঘন্টা শুনেও খেতে না এলে কি প্যাঁচা পাঠিয়ে ঠোকর মারাবি?

"আহ মা! ওটা ডেকোরেশন!"

বুঝলুম। অবশ্য ভেবে দেখলে, অন্ন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর বাহনটিকে ডেকোরেশন হিসাবে রান্নাঘরে সাজিয়ে রাখলে মানানসই হয় বইকি!

তারপর রাঁধুনী রাঁধতে বসল। ও বাবা, সে কী ঘোর রান্না! এই বলে বেগুনভাজা কেটে দাও, এই বলে পিজার উপর চিজ কুরিয়ে দাও! রেঁধেই যাচ্ছে, রেঁধেই যাচ্ছে, মাকে আর চান্স দেয়ই না! মায়ের গালটি ফুলতে ফুলতে যখন ফ্যান উপুড় করা হাঁড়িটার মতো গোল হয়ে এসেছে, তখন দয়াপরবশ হয়ে তিনি সরে বসলেন। 

"তুই তো সবই রেঁধে ফেলেছিস! আমি আর কী রাঁধি বল দিকি! বরং তুই বোস, আমি সাজিয়ে দিই।"

থালা ঘিরে বাটি সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার পর মায়ের  মাথায় কী যে চিড়িং খেলে যায়! আঙুল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে বলতে থাকে, থালায় বেড়ে দিই বুদ্ধি, সাহস, কর্তব্যবোধ, ধৈর্য আর স্বাস্থ্য। এই বাটিতে রইল ঘরের আঙিনা, আর এই বাটিতে রইল ঘুরে বেড়ানোর, দেশ বিদেশ দেখা। এই বাটিতে কাজ করার নেশা, এই বাটিতে নিজেকে নিয়ে সন্তোষ। এই বাটিতে দিলুম স্বপ্ন দেখার মন, আর এইটিতে লড়াই করার জেদ। আর এই গ্লাসে কানায় কানায় ভর্তি করে ঢেলে দিলুম আপনজনার আদর। 

মেয়ে অবাক চোখে দেখে মায়ের কাণ্ড। দেখতে দেখতে মায়ের কোলে ঠেলে উঠে বসে, চুপটি করে কী যেন ভাবে। তাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে মা কানে কানে শেষ কথাটি বলে দেয়,  রান্নায় নুনের মত, এই সবেতেই ভালোবাসাটি মিশিয়ে দিতে ভুলিস না যেন কখনো! দেখবি, জীবন কত স্বাদের, কত তৃপ্তির!