Tuesday, 31 May 2016

বৃষ্টিদিন



  
( তিতির এখন লন্ডন এসেছে তার বাপির কাছে। এখানে এসে বেশ কিছুদিন দারুণ সুন্দর রোদ ঝকঝকে দিন পাওয়া গেছে, ভালোয় ভালোয় স্কটল্যান্ডটাও জম্পেশ ঘোরা গেছে। সেসব গপ্পোও হবে পরে, কিন্তু আজ সক্কাল থেকে মেঘলা আকাশ, স্যাঁৎসেঁতে দিন আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি – পাক্কা লন্ডন ওয়েদার যাকে বলে! 

তো এমন দিনও তো বেশ কিছু দেখতে হয়েছে এসে অবধি, তাই আজ লিখতে বসে ভাবলাম এসব দিনে আমরা কি করি ঘরে বসে তাই লিখে রাখি। মানে, লেখাপড়া ছবি আঁকা এসব ছাড়া আর কি! )

   তিতিরকে কাক, চড়ুই, টিয়া আর চিলপাখির গল্প বলেছিলুম কদিন। গল্প মানে যা মনে আসে, তারা এক গাছে থাকে, একসাথে একদিন সমুদ্দুর দেখতে গেল, পথে কত কি কান্ড করল সেই সব।

    দুধের গ্লাস হাতে জানলায় মুখ বাড়িয়ে রোজের খেলাটা খেলছিলুম আমরা। খেলাটা আর কিছুই না – রাস্তা দিয়ে যত লোক হনহন করে বা ল্যাগব্যাগ করে যাচ্ছে, তারা সোজা যাবে না ডানদিকের রাস্তা ধরবে সেটা আন্দাজ করা – খেলতে খেলতে তিতিরের হঠাৎ আবিষ্কার যে রাস্তার কোণের ডাস্টবিনটা উলটে পড়ে আছে। 

তাই তো! কি কান্ড! কি করে হল রে?

‘আরে চিলপাখিটা সকালে এসে ওটায় বসেছিল তো! আর ডানা ঝাপটাচ্ছিল আর ওটা উলটে পড়ে গেছে!’

বলিস কি! তুই কি করে জানলি?

‘আমি দেখতে পেলুম তো! শুয়ে শুয়ে এমনি করে দেখছিলুম চোখ পিটপিট করে, তুমি টের পাওনি।‘

ও হো। তা চিলপাখি এখন কি করছে?

‘ঐ যে, ঐ দূরের বাড়িটার চিমনিটার ওপর বসে। দেখছ না? বসে বসে ভাবছে দুপুরে কি খাবে। দেখতে পাচ্ছ না?’

সত্যি দেখতে পেলুম যেন। সেই সঙ্গে, দূরে যেন ‘টং লিং’ও শুনতে পেলুম। আহা, আমারও তো ‘বিশে’ আর ‘সিংহ’ র মত সঙ্গী ছিল এরকম বয়েসে!
-------------------

   মেয়েকে বললুম আয় তাস খেলি। ডিজনির  অ্যালিস দেখা আর দাদুমণির কাছে ‘আজব দেশে অমলা’ পড়া মেয়ে দাবি করে বসল ‘আমার অমলার মত তাস চাই, যারা নিজে থেকে নড়াচড়া করবে নাচগান করবে’।

   সে আর কোথায় পাব, কাজেই খেলনা টিয়াপাখি, একটা ভাঙ্গা বাক্স আর কিছু মেকানোর নাটবলটু দিয়ে একটা পাখির বাসা বানানো গেল। পাখির নানা কাজ, উড়ছে, নাটবলটুতে (মানে ডিমে) তা দিচ্ছে, খাবার নিয়ে আসছে...খানিক পরে দেখি তিতিরের চুল বাঁধার রংবেরং এর রাবারব্যান্ড আসছে টিয়ার মুখে এক এক করে, সেগুলো নাকি ‘পকা মাকো’ (পোকা মাকড়)।

   এই অবধি বেশ ছিল। কিন্তু এর পর দাবি হল টিয়ার ডিম ফুটে ছানা হয়েছে, আর সেই ছানাটা হল – ইয়ে, মানে, আমি। তা, সেও কষ্টেসৃষ্টে ছানা সেজে উবু হয়ে বসেছিলুম বাসার প্রান্তে...কিন্তু যখন খিলখিল হাসি সহযোগে টিয়ার বকলমে তার তত্ত্বাবধক এসে জোর করে রাবার ব্যান্ডের কেঁচো খাইয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল, তখন ‘এই দ্যাখ ছানার ডানা গজিয়েছে বাসা ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে’ বলে পিঠটান দেওয়া ছাড়া গতি রইল না!

---------------------------------

    ছানার এহেন বেয়াড়া কর্মে তিতির বেশ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর আমার ছানা আমার কোলে এসে গুটিসুটি হয়ে বসে বলল, ‘মা, গল্প বলব শোন।‘

‘গল্প? ইয়াহহ...আমি গল্প খুব ভালবাসি। বল বল।‘

গল্পটা হুবহু তুলে দিলাম –

দুটো ব্যানানার গল্প
-------------------

দুটো ব্যানানা ছিল। ওরা যখন ছোট ছিল তখন ওরা স্যাটান্‌ এ থাকত। তারপর ওরা একদিন বেড়াতে বেরল। ঘুরতে ঘুরতে ওরা পৃথিবীর কাছে এল। তখন পৃথিবী ওদের দেখে হাসল। ওরা তখন পৃথিবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে আর কোলে নিয়ে লোফালুফি করেছে। তখন পৃথিবীর কাতুকুতু লেগেছে বলে খুব হেসেছে। ওদের পছন্দ হয়েছে, সেই থেকে ব্যানানা গুলো পৃথিবীতেই থাকে। এদিকে, পৃথিবী হেসেছে বলে ভূমিকম্প হয়ে ঘরবাড়ি সব ভেঙ্গে গেছে। তখন ব্যানানাগুলো বাজার থেকে অনেক আপেল কিনে এনেছে আর সব্বাই ইয়াম ইয়াম করে আপেল খেয়েছে। হয়ে গেল গল্প। 

-------------------------------------------------

বাইরে তেমনি ভেজা-ভেজা দিন। ঘরে চান করে ভাত খেয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে মেয়ে ঘুমঘুম যায়। মা জানলায় দাঁড়িয়ে দেখে ঐ দূরে আকাশে, সোনালি ডানার চিল উড়ে বেড়াচ্ছে – আর কেউ যাকে দেখতেই পায় না। 

তিতির না দেখালে, আমিও হয়তো দেখতে পেতাম না আর।

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে...


Sunday, 15 May 2016

নতুন ক্লাস



দেখতে দেখতে তিতিরেরও এক বছর স্কুল হয়ে গেল। প্রি-প্রেপ থেকে প্রেপ-এ উঠে গেলেন কন্যা। আর কি বদল হল না হল পরে টের পাব, আপাতত যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হল সক্কাল সক্কাল স্কুল, আর এবার থেকে শনিবারেও স্কুল।

    (কাজেই, শনিবার আমারও একটু ভোরবেলার আয়েশ করা বন্ধ এবার থেকে। সেদিন যেহেতু আমি বাড়িতে থাকব তিতিরের হুকুম “মা ইস্কুলে দিয়েও আসবে নিয়েও আসবে আর একদম দুত্তুমি করবে না।” শেষ পার্টটার কোন মাথামুন্ডু নেই, তার মা জীবনে কখনোই দুষ্টুমি জিনিসটা ঠিক করে উঠতে পারেনি – কিন্তু তিতিরের দাবি ওটা নাকি ‘বলতেই হয়!’)

    যাক সে তো পরের কথা। অদ্য ছিল প্রথম শনিবার। বাড়িতে এখন তিতিরের দিম্মা হাজির, তাই কিঞ্চিৎ ফাঁকি দেবার চেষ্টা করেছিলুম। মানে ভোররাত্রে উঠে পাশের ঘরে গিয়ে শুয়েছিলুম। কিন্তু তিতিরকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নাকি! গাঢ় গভীর ঘুমের মধ্যে ‘আঁক্‌’ করে উঠে পড়তে হল – পিঠে একতাল আলুর বস্তার মত ভারি কিছু এসে পড়েছে আর কানের ঠিক ফুটোর সামনে তারসপ্তকে “ম্যাাা” চীৎকার। সেই সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে তিতিরের দিম্মা আর আন্টির হাঁকডাক।

    ঘুম তো গেল, কিন্তু উঠে বসব কি! তিতির পিঠে ঘোড়সওয়ার হয়ে গেছে। তার দাবি সে ঐভাবে বসেই দাঁত ব্রাশ করবে। যদি বা দিম্মা ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেল, বারান্দায় গিয়েই আবার চীলচিৎকার শুরু “দেখবে এসো মা দেখবে এসো, লাল লাল সুয্যিমামা! একদম রেড!”

    ঠিক, এদ্দিন তো এতটা ভোরে উঠত না, টুকটুকে লাল সূর্য আগে দেখেনি বোধহয়।

    তা মেয়ে লক্ষ্মী বলতে হবে। ঠিক সময় মত দুধ বিস্কুট খেয়ে সেজেগুজে রেডি হয়ে গেল। মায়ের তখনো চা গরম বলে ফুঁ দিয়ে গলঃধকরণ করার চেষ্টা চলছে – পায় হাওয়াই চটি (না না নীল স্ট্র্যাপ নয়), মাথার চুল চুড়ো করে আটকানো এখনো আঁচড়ানো হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিতির বেশ নিশ্চিন্তে খেলার শিশি বোতল এনে টিভিটাকে মিছিমিছি তেল মাখাতে লেগে গেল – মার তো এখনো ঢের দেরি!

    আমি অবশ্য পাঁচ মিনিটে রেডি। রাস্তায় হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আর প্রতি তিন চার পা বাদে বাদে হাত পালটাতে পালটাতে চললুম – এটাই নাকি আজকে হাঁটার নিয়মগলির মোড়টায় এসে তিতিরের প্রশ্ন, “মা! আমার কি আজ ইস্কুল?”

    “হ্যাঁ মা।”

    “তোমার কি আজ অপিশ?” বেশ একটু উদ্বিগ্ন গলা।

    “না রে, আজ তো শনিবার। আজ আমার অফিস ছুটি। তোকে স্কুল থেকে নিতে আসব দেখিস।”

    “আজ তাহলে আমার ইস্কুল আর তোমার ছুটি?”

    “ঠিক!”

    কয়েক পা চুপচাপ। গবেষণা চলছে কিছু একটা। তারপর সিদ্ধান্ত প্রকাশ, “অপিশ না গিয়ে তুমিও যদি আমার সাথে ইস্কুল যেতে, ভালোই হত! বেশ তুমি আর আমি পাশাপাশি ইয়েলো চেয়ারে বসতুম!”

Monday, 2 May 2016

কাঁকড়া


“কুমীরভায়া! বাড়ি আছ নাকি?”

    সকালবেলা বাজার টাজার সেরে এসে চা আর কাগজ নিয়ে বসেছিলুম সবে। কন্যার আগমন। হাতে একটা বদখত শেপের পুঁটলি – ঘোরতর সন্দেহজনক হাসি মুখে।

    “অ্যাঁ! কে? কি?”

    “আমি কাঁকলা, তুমি কুমীর। আমরা বন্ধু-বন্ধু তো, তাই আমি তোমার বাড়ি বেড়াতে এসেছি।”

    ও আচ্ছা। তাড়াতাড়ি কাগজ গুটিয়ে ‘কাঁকড়া’কে বসবার জায়গা করে দিই। বসে না, পুঁটলিটা রাখে। রেখে বলে,

    “আমি এখন চান কব্বো। তোমার বাড়ির পিছনে পুকুর আছে সেখানে চান কব্বো। তুমি আমার জন্য খিচুড়ি রান্না করে রাখো।”

    “পুকুর আবার কই?”

    “আঃ!! তুমি কুমীর না? তোমার বাড়ির পিছনে পুকুর আছে বলছি!”

    চা খাওয়া মাথায় উঠলো। খিচুড়ি রান্নার জোগাড় করতে লাগতে হল – পিঙ্ক সসপ্যান, হলুদ থালা, নীল জলের গ্লাস ইত্যাদি। কাঁকড়া ওদিকে সোফা আর ডিভানের মধ্যের ফাঁকটায় নেমে পড়েছে – লাফিয়ে লাফিয়ে ‘পুকুরে’ চান হচ্ছে।

    পুঁটলিটা খুলে তার কাপড়টা দিয়ে তোয়ালে করেছে – সন্দেহজনক হাসিটার কারণ বুঝলাম এবার – কোন ফাঁকে আমার ড্রেসিং টেবিল খালি করে ক্লিপ আর চুড়ি তুলে এনেছে টেরই পাইনি। অন্যান্য মালপত্তরও সরেশ সব – একটা বল, একটা মাথা ভাঙ্গা পুতুল, একটা ট্রেনের ইঞ্জিন, বোলিং পিন দুটো।

    চান করে তিনি তো খেতে বসলেন। ওমা, দুগাল খেয়েই বলে, “চলি, আমায় আবার অনেকদূর যেতে হবে তো, অন্ধকার হয়ে গেলে মুক্কিল হবে।”

    বলে, নিজের যা যা জিনিস এনেছিল সেসব তো বটেই, এমনকি খিচুড়ির বাটি থালা গ্লাস অবধি সবশুদ্ধু পুঁটলি বেঁধে ফেলল। ছাঁদা বাঁধার চরম আর কি! অতিথি, কি আর বলি!

    যেতে গিয়ে, নিজেই জল ফেলেছিল কি কি করেছিল কে জানে, পা পিছলে ধুপ করে বসে পড়ল।  লাগে টাগে নি অবশ্য, তবে কিনা ‘বন্ধু’র সামনে পড়ে গিয়ে প্রেস্টিজ ক্ষুণ্ণ হল তো, তাই বাণী দিয়ে গেল, “কাঁকড়ার মত পাশাপাশি হাঁটতে ভুলে গেছিলুম কিনা, ঐজন্য পড়ে গেলুম!”