Sunday 14 August 2016

পেঁপেগাছের গল্প



রাত নিঝঝুম। বাড়ির আলো নিভেছে সব।
বিষ্টি বিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু মাথার ওপর ফুল স্পীডে পাখা চলছে, কারণ মশারি খাটানো হয়েছে।
মশারি, মানে ঘরের মাঝে ঘর। তার মধ্যে মা আর পুঁচকেপানা মেয়ে। তার কিলবিল করা আর ফুরোচ্ছে না। একবার মায়ের হাঁটুর ওপর ঠ্যাং তুলে দেয়, তো পরক্ষণেই মুন্ডু দিয়ে কাঁধে গোঁত্তা মারে। নিজের হাতটা নিয়ে তার নতুন অভিনেতার মত সংশয় আছে, কোথায় রাখবে ভেবে পায় না – ফলে নাকে, বুকে, পেটে সর্বত্র থাবড়া খেতে থাকি।
সেই সঙ্গে, সরু সরু গলায় বায়না, “গঁপ্প বঁলো...”
এই অবধি রোজের গল্প। এরপর আমি কোনদিন মরুভূমির (মরুভূমির কথা বলতে গেলেই জনসন আর রনসনকে কেন মনে পড়ে কে জানে!), কোনদিন মহিষাসুরের (এইটা একটা যা-তা  আজগুবী সিরিজ হচ্ছে। বলব পরে কখনো), কোনদিন অলিম্পিক্সের (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সও জানা উচিত, বলুন?) – মানে যেদিন যা মনে আসে সেই গল্প শোনাই তাকে।
আজ একটু অন্যরকম হল।
আমি কিছু বলার আগে, তিতির নিজেই বলে উঠল, “আমার মাথায় আজ প্রচুর ব্যাটারি আছে। ইলেবেন ব্যাটারি। আজ আমি গল্প বলব।”
নিজের সৌভাগ্যে চমৎকৃত হয়ে দু্কান খাড়া করে ফেললুম তৎক্ষণাৎ।
কিসের গল্প বলব?”
“যা খুশি, বল না!”
“না। কি নিয়ে বলব বলতে হবে। এমনি এমনি বলব না।”
মাথা কি আর কাজ করছে তখন! সেই সক্কাল সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি, সারাদিন ধরে আপিশে ঘোড়াড্ডিমে তা দিয়ে, তাপ্পর এক ঘন্টা বাস জার্নি করে এসে, ড্রাইভিং লেসন নেবার নামে ট্রেনারের হৃৎকম্প করিয়ে দিয়ে, সংসারের চাট্টি জিনিস কিনে আর চাট্টি ভুলে গিয়ে, বাড়ি ফিরে তিতিরের হোমটাস্ক করিয়ে, তার সাথে নর্তনকুর্দন করে, ডিনার পর্ব সেরে বিছানায় শোবার পর টুপ করে ঘুমে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না? যাইহোক, ওই যেগুলো আনতে ভুলে গেছি সেগুলোই মাথায় ঘুরছিল তখন। বলে ফেল্লুম, “একটা পেঁপেগাছের গল্প বল দিকি!”
“পেঁ-পে-গাচ!?” সরল চোখে বিস্ময় আর উৎসাহ মায়ের বিদঘুটে বায়না শুনে। দ্যাখ না দ্যাখ গল্প শুরু।
“একটা না, পেঁপেগাছ ছিল। ব-ড়ো পেঁপেগাছ।”
“কোথায় ছিল?” ব্যাগড়া দিয়ে ফেলি।
“ছিল? ছিল হচ্ছে...বলছি...ছিল রিলির দেশে।”
“অ্যাঁ? কোথায় বললি?”
“রিলি দেশে।”
আমার ঘুমকাতর মস্তিষ্ক ধাঁধার গন্ধ পেয়ে সজাগ। এটা কি বাংলা বর্ণমালা চেনার ফল?
“তিতির... ঋ-৯ দেশে? বাংলা ঋ-৯?”
“আরে না! রিলিইই দেশে, যেখান থেকে একটা দিদুন আমায় ফোন করে!”
বুঝে নিই।
“দিল্লি?”
“হ্যাঁ। ঐ রিলি দেশে ছিল তো পেঁপেগাছটা। তো রিলি দেশে না বুঝলে ভয়ানক ঠান্ডা পড়ে। একদম বরফ পড়ে যায় পেঙ্গুইন আর সীলমাছ দের দেশের মত। তাই পেঁপেগাছটার খুব ঠান্ডা লাগে।”
“তারপর?”
“তারপর...এই সব ছোট ছোট বাচ্চা আছে না এখানে? এই আমি, মিহির, বয় সজল, গার্ল সজল, সৌম্যা – আমরা সবাই গেছি ওখানে।”
(সত্যি ই দুটো সজল আছে বাড়িতে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে)
“বেশ তো। গিয়ে কি করলে?”
“আরে ঠান্ডা তো? আমরা বাচ্চারা মোটা মোটা জ্যাকেট পরে গেছি। আর গিয়ে বলছি ‘পেঁপে খাব, পেঁপে খাব’, কিন্তু গাছটায় একটাও পেঁপে হয়নি। ঠান্ডা বলে হয়নি। তাই আমরা খুব বায়না করছি কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। তখন আকাশ থেকে একটা পরী এসে ম্যাজিক করে দিল আর এত এত মিষ্টি পেঁপে হল গাছটায় আর আমরা ইয়াম ইয়াম করে খেয়ে চলে এলুম – হয়ে গেল গপ্পো।”
রেলগাড়ির স্পীডে গল্প শেষ।
“ও তিতির, এটা না খুব ভাল গল্প হয়েছে। এটা আমি লিখে রাখব কেমন?”
“হ্যাঁ। লিখে রেখো না!”
দমাস করে একটা পা এসে পড়ল পেটের ওপর।
“আমি কিন্তু এখন আর গল্প বলতেও পারব না শুনতেও পারব না, আমার ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে।”
এবং বিনা বাক্যব্যয়ে তিনি ব্যাটারি চার্জ করতে লেগে গেলেন, মানে ঘুমিয়ে পড়লেন, আমার একটা হাত ফোনের তারের মত মাথায় ঠেকিয়ে, আঁকড়ে ধরে।

No comments:

Post a Comment