Sunday, 4 March 2018

হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার


বসে বসে ঝাঁটা দেখছি।

চতুর্দিক ঝাঁটাময়।

নাঃ, ঝাঁটার দোকান দিইনি। যদিও চারদিকে যা জঞ্জাল, দিতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। তারপর বঙ্কিমের সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিগুলো মনে পড়ে যায়,
'
তোর মুখ তো নয়, ঝাঁটা!'
'
আর তোর মন আস্তাকুঁড়, এত ঝাঁটা চালিয়েও সাফ ' না।'
স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত, ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

সে যাক, কিন্তু এখন বিদ্যানিকেতন সম্মার্জনী-শোভিত।

ফ্যান্সি ড্রেসের অনুষ্ঠান। এগুলো আমাদের সময় কেন যে তত চল ছিল না কে জানে। আমার কত্ত দিনের সাধ ছিল একবার স্পাইডারম্যান সাজার! সে আর ইহজীবনে না গো! তিতিরও মাম্মা-কাট পাবলিক, তিনি চেয়েছিলেন ডোরা দ্য এক্সপ্লোরার সাজতে। কিন্তু জানা গেল এমনি ওমনি ফ্যান্সি ড্রেস নয়, থীমপুজোর মত এও থীমাধারী।ক্লিনিং মেটিরিয়ালসএর ওপর সাজতেই শুধু হবে না, কিছুক্ষণ বক্তৃতাও দিতে হবে।

থীম শোনামাত্র তিতিরের ঘোষণা, “আমি ন্যাতা হবো।

ন্যাতা? মানে ঘরমোছা ন্যাতা? সে কী করে বানাবো, আর হয়ে বলবি কী?”

ঐত্তো কাপড় মুড়ে ঝুলিয়ে দেবে, আর আমি বলব ন্যাতা দিয়ে ঘর মুছুন! বলে মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে লুটোপুটি খেয়ে দেখিয়ে দেব।

মানসচক্ষে দেখতে পেলুম, হল ভরা বাচ্চা কাচ্চা, তাদের কারো বাবা, কারো মা, কারো দাদা-নানা-নানী কেউ, কারো কারো কচি কচি ভাইবোন, তটস্থ টিচাররা, স্কুলের গম্ভীর মাথারা, প্রধান অতিথি কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তিসবার বিস্মিত বিস্ফারিত চোখের সামনে আমার কন্যা স্টেজের প্রান্ত থেকে প্রান্ত শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে; হলভর্তি লোকের ঠা-ঠা হাসি কানে এসে ধাক্কা মারল।

এই না না, স্টেজে কোথায় কী নোংরা আছে ঠিক নেই, ওসব গড়াগড়ি হবে না।

তিতিরের মুখ মেঘাচ্ছন্ন। বোঝা গেল ঐটির লোভেই ন্যাতায়িত হতে চেয়েছিল। মনের দু;খু কাটাতে পাশবালিশটাকে সাপটে ধরে খাটেই গড়াগড়ি খেতে লাগল।

ওদিকে আমি আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলুম। কী বানানো যায়! সাফ করার সরঞ্জাম ঝাঁটা ন্যাতা ছাড়া আর কী হয়, দেব নাকি ঘরমোছা বালতি করে? বা ভীম বার? লাইফবয় সাবান? ঝুলঝাড়ু? এইটে বেশ মনে ধরল, কিন্তু মুম্বইতে তো জিনিসটার চলই নেই, বুঝবে তো বিচারকরা?

পরদিন গুটিকয় বন্ধুকে জিগালুম। একজন বললে ওয়াশিং মেশিন, সেটা বেশ পছন্দ হল। খাটনি কম, একটা চৌকো বাক্স পরিয়ে দিলেই হবে, আর সামনে গোল ঢাকনা খোলা বন্ধ। কিংবা ভ্যাকুয়াম ক্লীনারও করে দেওয়া যায়, বেশী খাটার ইচ্ছে হলে।

অফিস থেকে আসতেই মেয়ে যথারীতি কোমর ধরে ঝুলে পড়ল তার ভুবনমোহিনী ফোকলা হাসি নিয়ে।

ম্যাঁ!!! আমি ফ্যান্সি ডেসে (ফুকলি তো, উচ্চারণ পিছলে যায়) নাম দিইচি!”

খুব ভালো করেছ মা। আমায় ব্যাগটা রাখতে দাও এবার।

অমনি আমার ব্যাগ কেড়ে নিয়ে কাঁধে করে, তার পা দিয়ে ঠেলা গাড়ি চড়ে সে দাদুমণির কাছেঅফিসচলে যায়। যাবার আগে বাণী ছেড়ে যায়, “আমি না, হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার হবো বলেছি।

ধুপ করে ডিভানে বসে পড়ি। নাহয় দুদিন আগেই মেয়েকে স্কুলব্যাগে রাখার জন্য একটা পুঁচকে মিকি মাউস আঁকা হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার এনে দিয়েছি, তাই বলে সেটাই বলে এলো!

ঢাকনা কী করে বানাবো রে বাপু!

কিন্তু বলে যখন এসেছে, তখন করতে হবে। একটা লম্বাটে শেপের প্যাকিং বাক্স পড়ে ছিল অনেকদিন, সেটা বধ করে বোতলের বডি হবে ঠিক করে নিই। ঢাকনা হবার উপযুক্ত কিছুর সন্ধানে রান্নাঘরের তাক, খাটের নীচ, আলমারির মাথা ঘেঁটে ফেলি, তিতিরের খেলনার ঝুড়ি হাঁটকিয়ে আমার বহু বহু কানের দুলের একপাটি উদ্ধার করে ফেলি যেগুলোর অন্য পাটি আমিরেখে কী লাভবলে কিছুকাল আগেই বিসর্জন দিয়েছি, পাড়ার দোকান তছনছ করে দিয়ে আসি। শেষে কিছু ফালতো কার্ডবোর্ড খুঁজে পাই, যা দিয়ে, হুঁ হুঁ, আর সঙ্গে ওই যে রান্নাঘরের তাকের নীচে সরিয়ে রাখা থার্মোকলের প্লেট, হুঁ হুঁ, আর থার্মোকলের বাটিও, হুঁ হুঁআইডিয়া হয়ে যায়।

তারও পর কত যে কাজ থাকে! বাক্স মাপমত কেটে সাইজ করা, ঘুরন্ত দুরন্ত মেয়েকে ধরে এনে এনে মা নেওয়া, তারপর তার বাক্স পরা অবস্থাতেই পোঁ করে পালিয়ে যাওয়া, আবার ধরে এনে বাবা বাছা করে বাক্স উদ্ধার, তারপর তাতে কাগজ মারতে গিয়ে কাগজ কম পড়ে যাওয়া, আবার দৌড়ে দোকান গিয়ে রঙ মিলিয়ে কাগজ কিনে আনা, তারপর তাতে ছবি আঁকা লেখা, তারপর সাংঘাতিক কৌশল করে কার্ডবোর্ড পাকিয়ে (আবার ব্রাউনিয়ন মোশনে ঘুরে বেরানো মেয়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে মাথার মাপ নিয়ে নিয়ে) মাথা ঘিরে শিশির ঢাকনা বানানো, তাতে নাক মুখের ফুটো কাটা, প্লেট আর বাটিতে কালো রঙ করা, ঢাকনার ওপর প্লেট আটকানো। তারপর তারো ওপর বাটিটা উলটো করে একদিকে লাগিয়ে দিতে সুন্দর টুক করে খোলা বন্ধ করার মত ব্যাপার হয়ে
গেলো।  এর সঙ্গে সঙ্গে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে ছোট্ট ইংরিজি স্ক্রীপ্ট মেয়েকে বলতে শেখানো

সেরাত্রে তিতির ঢাকনা হেলমেটের মত মাথায় পরে ঘুমোতে চেয়েছিল। বহু কষ্টে আটকানো গেছে।

তো সেসব তো আগের দিনের গল্প। এখন হলে এসে বসে আছি সবাই, এই শুরু হল বলে অনুষ্ঠান। এবং বসে বসে ঝাঁটা দেখছি। সে যে কত রকমের ঝাড়ু ভাবা যায় না। কারুর খাসা হাতল আছে, কারো শুধুই ফুলঝাড়ু নেতিয়ে পড়ছে বুকের নিচে থেকে। কেউ খ্যাংরার কাঠি বেঁধে এসেছে কোমর ঘিরে। আহা কত নতুন ফুলঝাড়ু আর খ্যাংরা ধ্বংস হয়েছে এই সাজুগুজুর ঠেলায়! কেউ স্রেফ ঝাড়ুদার সেজে হাতে একটা আস্ত ঝাঁটা নিয়ে চলে এসেছে, এটা ভালো বুদ্ধি, ঝাঁটাটা অন্তত ব্যবহার করা যাবে পরে দেখতে দেখতেই পায়ে সুড়সুড়ি খেয়ে লাফিয়ে উঠতে হয়, আরো ঝাঁটা, এবং এটা সত্যিকারের। হল ঝাঁট দিচ্ছে স্কুলের মৌসি।

অনুষ্ঠান শুরু হবার পর দেখলুম, ঝাঁটা তো সংখ্যাগুরু বটেই, ডেটল সাবান আর ডাস্টবীনও নেহাত কম না। গুটিকয় ফিনাইলও ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। সবার মধ্যে অনন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার, কালো ঢাকনার ফাঁক দিয়ে তার চম্পা পরা চোখ আর ফোকলা দাঁতের হাসি ঝলসে উঠছে বার বার।

ছোট্ট ছানাপোনা সব, স্টেজে উঠে প্রায় সবাইই মাঝপথে ভুলে যাচ্ছে, কিংবা খেই হারিয়ে ফেলে আধখানা বাক্য বলেই পরেরটায় চলে যাচ্ছে। সে খুব মিষ্টি ব্যাপার। কিন্তু কারো কারো বিপদ তার চেয়েও বেশী। কোমরে খাড়া খাড়া খ্যাংরা ঝাঁটা কাঠি ঘাগরার মতো করে বাঁধা বালকের বসার উপায় নেই, সারাক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে সে গেল চটে। এক আপাদমস্তক ঢাকা চমৎকার ডাস্টবীন স্টেজে উঠতে গিয়ে আটকে গিয়ে যযৌ তস্থৌ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, বেচারি পা নাড়তে পারছে না। তাকে ডাস্টবীনের কবলমুক্ত করে মাইকের সামনে নিয়ে গিয়ে আবার ডাস্টবীন পরানো হল। তার চেয়েও মুশকিল হল এক রংচঙে ঝাঁটার, মাথার উপর দিয়ে খাসা গলিয়ে পরা ব্যাপার ছিল সেটা। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করল, চোখ নাকের ফুটো থাকলেও মুখের কোনো ফুটো কাটা হয়নি, ফলে কথা শোনা যাচ্ছে না। আবার তার মা দৌড়লো সেটা খুলে দিতে, কস্টিউম বগলে নিয়ে অতঃপর সে মেয়ে তার বক্তব্য পেশ করল।  

তিতির কিন্তু খাসা বলেছে মোটের ওপর। একটু মাঝে আটকে তো সবাই গেছে! তার চেয়েও মজার কাণ্ড কী হয়েছে জানো? ঠিক শেষদিকে এসে হাওয়ায় পুট করে উপরের বাটিটা উলটে গেছিল, ঠিক যেন কেউ স্যানিটাইজারের উপরের ক্যাপটা খুললো।

অ্যাঁ, রেজাল্ট? দূর, বাচ্চাদের শো। ওর আবার রেজাল্ট কী! সব্বাই জিতেছে, সব্বাই একসাথে মজা করে ছবি টবি তুলেছে, হই হই করেছে, দৌড়াদৌড়ি করেছে। হয়ে যাবার পর যে যার কিছু কিঞ্চিৎ ভাঙা তুবড়োনো কাঠি খুলে যাওয়া কি সেলোটেপ ঝুলে থাকা ক্লিনিং মেটিরিয়াল বগলদাবা করে বাড়ি ফিরেছি, কচিমুখের কলকল গল্প আর গালভরা হাসি সহ। এই আনন্দটুকু দেখার জন্য, একটা গোটা ছুটির দিনের খাটনি দিব্যি পোষায়, তাই না!

2 comments: