Saturday, 17 February 2018

মিঠিদিদি


  


“ও তিতির! অমন কিলবিল করিস কেন রে? ঘুম আসছে না?”

“উম্মম্মম্মম...গপ্পো বলো!”

“কিসের গপ্পো বলি বল? উটপাখি? আন্দামানের জারোয়ারা? নাকি সালোকসংশ্লেষের?”

মেয়ে নড়েচড়ে আরো ঘেঁষে আসে। পেটে কনুইয়ের খোঁচা খাই। কাতুকুতু লাগলে আরো বেশি করে জাপটে ধরা নিয়ম। তাতে আরো হাসি পায়, দুজনেরই। 

“তুমি না, বাচ্চা মাম্মার গল্প বলো। সেই যে টুম্পা ছাতে খেলা করছিল আর কাক এসে তার হাঁটু নিয়ে চলে গেল?”

“এই খবরদার তিতির, ও গল্প তুমি শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছ। আর আমি মোটেও অমন পচা গল্প বলব না, ওসব তুমি দাদুমণির কাছেই শোনো গে’!”

“আমার বেঁবির গপ্পো চ্চাঁই!”

“বেবি তিতিরের গল্প বলি, হ্যাঁ রে?”

মাথা নাড়ানোর চোটে চিবুকে মোক্ষম গুঁতো খাই। আমার আহত কাতরোক্তিতে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে ভদ্রমহিলা বলে বসেন, “ওসব তো আমিই বলতে পারি, তুমি আবার কী বলবে?”

এত গুল সহ্য হয় না আমার। “তোকে ছমাসে কেমন কোলে করে পায়চারি করে করে ঘুম পাড়াতুম আমি আর দিম্মা মিলে, সে গল্প তুই বলবি? বলতে পারবি? বাজে বকিস না!”

“হুঁ! ওই তো লম্বা বারান্দাটায় পায়চারি করতে করতে, এমনি এমনি করে দোলানো হত আর থামলেই তিতির পটাং করে চোখ খুলে জুলজুল করে তাকাত...”

রণে ভঙ্গ দিই। ব্যাটা দিম্মার কাছে সব গল্প শুনে মুখস্থ করে রেখেছে। আর কোন বেবির গল্প পাই ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে যায়...

জানি তো! আরেকজনের মজার কাণ্ডকারখানা। সে এখন ভারী লক্ষ্মী মেয়ে। কিন্তু মজাদার ছোটবেলার গল্প তো সবারই থাকে, এমনকী আট বছুরে খুকির-ও!

হাত পা সব দিয়ে সাপ্টে ধরে বলতে শুরু করি, “তোকে মিঠিদিদির গপ্পো বলি শোন। মনে আছে তো মিঠিদিদিকে?”

“হুঁউউউ! আমরা বাসের ছাতে চড়েছিলুম।“

ঠিক। ডিসেম্বরের ছুটিতে দুই কন্যার দেখা হয়েছিল সিটি সেন্টার টু তে, তারা খেলনা বাসের ছাতে চেপে চক্কর কাটছিল আর মিঠিদিদির বাবা, সোমনাথ তাদের পাহারা দিয়ে চক্কর কাটছিল, আর অর্পিতা আর আমি চুপি চুপি যত গোপন গল্প করে নিচ্ছিলুম সেই ফাঁকে!

“হ্যাঁ, তা শোন না, সেই মিঠিদিদি যখন খুদে ছিল...”

শুরুতেই পরম ব্যাঘাত। 

“মিঠিদিদি তো এখনও খুদে!”

“আরে ধ্যাৎ! মিঠিদিদি খুদে আর তুই ধেড়ে? তুইও খুদে তো...আচ্ছা বাপু নে, মিঠিদিদি যখন আরো খুদে, প্রায় বেবি ছিল তখনকার গল্প।“

“দুদুন খেত কোলে চেপে?”

“অ্যাইও! তুই গল্পটা বলতে দিবি, না বক্কেশ্বরীর মত বকবক করবি?”

মেয়ে ফিচিক ফিচিক হেসে চুপ করে।

“মিঠিদিদির মাম্মা না, মিঠিদিদির দিম্মার গোপালকে দেবে বলে একটা রুপোর থালা কিনেছে। পুঁচকে থালা। আর সারপ্রাইজ দেবে বলে মিঠিদিদিকে বলে দিয়েছে কাউক্কে যেন না বলে। কিন্তু মিঠিদিদির তো খুব বুদ্ধি, সে ঘাড় নাড়িয়ে তার মাম্মাকে বলে কি, ‘হয়নি, হয়নি, ফেল! গোপাল তো সব টের পায়, তুমি থালা কিনতেই ও জেনে ফেলেছে, তুমি আর ওকে সারপ্রাইজ দিতে পারবেই না!”

তিতির মজা পায়, তারপর ভেবেচিন্তে মন্তব্য করে, “আরে, কিন্তু সেই দিম্মা তো আর টের পায়নি! তাকে তো সারপ্রাইজ দেওয়া গেল, না? তুমি যেমন আমার পুতুলের জন্য চায়ের কাপ ডিশ কিনে এনে সারপ্রাইজ দাও তেমনি তো? বলো না মা, গোপাল-পুতুলের থালা পেয়ে সেই দিদুন কী বলেছিল? ইয়ে য়ে য়ে করে মিঠিদিদির মাম্মার কোলে উঠে গেছিল, আমি যেমন যাই?”

আমি স্বভাববশতঃ ব্যাপারটা কল্পনার চোখে দেখে ফেলি, ফেলে প্রবল মনের জোরে হাস্য সংবরণ করি। মেয়ে ততক্ষণে “আরেট্টা আরেট্টা” বায়না জুড়েছে।

“জানিস তো, মিঠিদিদি খুব ছোট্ট থেকে পড়তে পারে। (ওদিকে গম্ভীর গলার দাবি, আমিও পারি।) হ্যাঁ তুইও পারিস, কিন্তু শোন না। একটা শ্যাম্পু পাওয়া যায় বুঝলি, সেটার নামের বানান হ’ল বি-ই-ই-র...”

“বীর!”

আমার বীরাঙ্গনার সগর্ব উচ্চারণ। গল্পের শুরুটা মাঠে মারা যায় কারণ মিঠিও “বীর”ই পড়েছিল। যাকগে, পরেরটুকু বলি। 

“তারপর একদিন বাসে করে যাচ্ছে ওরা, আর একটা দোকানের সাইনবোর্ড দেখে মিঠিদিদির সারা বাস কাঁপিয়ে চীৎকার, ‘ঐ দেখো বাবার বীর শ্যাম্পুর দোকান’।”

“সবাই হাসল, মা?”

“হ্যাঁ তো। মজার না?”

“হুম। আচ্ছা মা, তুমি কোন শ্যাম্পু মাখো গো?”

অদূর ভবিষ্যতে গোলমাল আসন্ন টের পাই। ধাঁ করে পরের গল্পে ঢুকে পড়ি।

“মিঠিদিদি যখন প্রথম দুর্গাপুজো দেখে তখন তার বয়েস বছর দুই, বুঝলি। তোর মনে আছে তো, তোকেও একবার কলকাতা নিয়ে গেছিলুম দুর্গাপুজো দেখতে?”

“হুঁ, মঈশাসুর। মা, ও মা, মঈশাসুরের গল্প বলবে?”

“না এখন মঈশাসুরের গল্প বলতে পারব না। এখন মিঠিদিদির গল্প হচ্ছে। তা মিঠিদিদি শুনছে সবাই দুগগা মা বলছে...”

কান ফুটো হয়ে গেল। পাশের জন “দুগগা মাঈকি জ্য্য্যায়!” করে হাঁক পেড়েছে। 

“তো শুনে শুনে মিঠিদিদির মনে প্রশ্ন জেগেছে, দুর্গা কার মা? মিঠিদিদির মা তো বুঝিয়ে বলেছে...”

“লোক্‌খী সরসসসোতী কাত্তিক গণশা...”

“হ্যাঁ সে তো বটেই। মিঠিদিদির মা বলেছে, তারপর আরো সবার মা, এই চারদিকে যারা আছে, তোমার বাবা মা তুমি – সবার মা...তা মিঠিদিদি শুনে কী বলেছে জানিস? বলেছে, ‘আর সবার মা হচ্ছে ঠিক আছে, আমার মা নয় – আমার তো মা আছে!”

একটা কচি কচি হাত গলা জড়িয়ে ধরে। পরম পরিতৃপ্তির গলায় এক প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ  অভিজ্ঞ ভদ্রমহিলা ছোট্ট মিঠিদিদির কথায় অনুমোদনের শীলমোহর লাগিয়ে দেন, “ঠিকই তো বলেছে! যাদের মা নেই, তাদের মা হোক দুর্গা মা। আমাদের তো নিজের মাম্মা আছেই!”

মিঠিদিদির মাম্মার কাছে এ গল্পটা শুনে প্রথমবার যেমন চোখের কোণ ভিজে গেছিল, আবার তেমন ভিজে ভিজে লাগে। ছোট্ট মানুষেরা, তোরা আছিস বলেই না আমার মত খুব সাধারণ মানুষরা দুর্গা-মা হয়ে ওঠার ম্যাজিকটা খুঁজে পেয়ে যায়!


No comments:

Post a Comment