Sunday 24 March 2019

রাজা ও বাঁদরছানা


“ও তিতির।  আর কতক্ষণ ধরে খাবি? মুখ চালা রে!”
“আমি তো যথাসম্ভব দ্রুত খাচ্ছি মা!”
আজ্ঞে। ওই হতভম্ব সরলহৃদয়া স্নেহশীলা (উভয়ার্থে ) মহিলাটি আমিই। হাঁ করে যার দিকে চমৎকৃত চক্ষে চেয়ে আছি, সেও আমারই একমাত্তর নাড়ি ছেঁড়া ধন। 
নাহয় শীর্ষেন্দু পড়াই, নাহয় ত্রৈলোক্যনাথ পড়াচ্ছি। তাই বলে একটা আজন্ম বোম্বেতে বড় হওয়া  স্কুলে ইংলিশ হিন্দি মারাঠি শেখা ছানা এমন শুদ্ধ বাংলায় জবাব দেবে! এটা বাক্যালাপ, না শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস হে!
মনের মধ্যে গুনগুন করে জবাব আসে, আর তুমি নিজে যে সুযোগ পেলেই স্কুলের খাতায় বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় রচনা লিখে আসতে, তার বেলা?
যাকগে যাক। কিন্তু এদিকে সত্যিই যে মুখ বড়ই ধীরে চলছে। সমস্ত মনোযোগ কালি ফুরোনো ডটপেন আর বাতিল টুথব্রাশ দিয়ে ডাইনোসরের ডেন্টাল ক্লিনিং এ। এবার মাকে আসরে নামতেই হয় দেখছি।
"এই শোন না। একটা খাসা গল্প পেয়েছি। মৈ মাসি দিয়েছে৷ শোন না, শুনবি?"
যেই না গল্পের লোভে স্থির হয়ে বসেছে, টপ করে মাছভাতের গোল্লা যথাস্থানে চালান করি। 
"হুঁ শোন। একটা না রাজা ছিল। রাজার না একদিন শখ হয়েছে শিকার করতে যাবে।"
"মী-গয়া।"
"ঠিক ঠিক৷ মৃগয়া করতে যাবে।  (এটা ছবিতে রামায়ণের ফল) তো রাজা তো রেডি হল সেই মত - খাকি জামা আর হাফপ্যান্ট পরেছে, চোখে সানগ্লাস, মাথায় টুপি, আর পায়ে বুটজুতো।"
রাজার হাফপ্যান্ট বা টুপি যদি বা সহ্য করে নিয়েছিল, বুটজুতো আর সইল না।
"নায়ায়ায়ায়ায়ায়া! রাজা পায়ে নাগরা পরে।"
 আমিও ছাড়তে রাজি নই। 
"এহ, যাচ্ছে জঙ্গলে, কত কাঁটা খোঁচা পোকা মাকড় জোঁক আছে তার ঠিক নেই - নাগরা ফাগরা চলবে না।"
খানিক টালবাহানার পর ঠিক হল সে রাজকীয় বুট পরবে, তার ডগাটা নাগরার মত শুঁড়তোলা।
“চলল রাজা তরোয়াল বাগিয়ে ধপাং ধপাং করে। জঙ্গলে ঢুকে দেখে কি…”
“বাঘ নাঁ!”
“আচ্ছা বাঘ না। দেখে কি একটা…”
“ভাল্লুক নাঁ!”
“অ্যাঁ! আচ্ছা বাঘ ভাল্লুক কিছুই না। দেখে কি একটা বাঁদর। খুব মিষ্টি দেখতে বুঝলি…”
“আমার মত?”
এরকম ভয়ংকর বিপজ্জনক দোরোখা কোচ্চেনের উত্তর দিয়ে ফাঁসি আর কী! না না আমি অত বোকা নই।
“না, ওটা বয় বাঁদর। মানে বাঁদর, বাঁদরী নয়।“
“তাহলে সামু মামুর মত মিষ্টি দেখতে।“
নিশ্চিত প্রত্যয়ের ঘোষণা। যাকগে, সে সামু মামু বুঝবে এখন। আমি গল্প আগে বাড়াই।
“হ্যাঁ সেটা আসলে বেবি ছিল জানিস। সে না, একদম মায়ের কথা শুনত না আর সারাক্ষণ খাবার দাবার ফেলে লাফিয়ে বেড়াত বলে তার মা খুব বকেছিল। তাই সে বাড়ি থেকে পালিয়ে জঙ্গলে চলে এসেছিল।“
যা মাথায়্ আসে তাই বকে যাই। এখনো মাছভাত বাকি, তারপর চিনি দেওয়া দইয়ের বাটি অপেক্ষা করছে।
“আর তারপর না …রাজা আর বাঁদরে যুদ্ধ। সে কী যুদ্ধ ভাবতে পারবি না। শেষে বাঁদর দিয়েছে একটা বিকট বাঁদুরে ভেংচি কেটে – আর রাজা ভয়ে পগারপার।“
“মা? মাম্মা বাঁদর কাঁদছে না?”
যার যেদিকে মন!
“হ্যাঁ রে, মাম্মা বাঁদরের তো খুব মন খারাপ। সে সব জায়গায় ছানা খুঁজতে খুঁজতে এসে রাজপ্রাসাদে হাজির। সেখানে এসে দেখে রাজা মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে তার চেয়েও জোরে হাউ হাউ করে কাঁদছে।
আরে, আরে, কাঁদে না! এই নাও বাঁদুরে বিস্কুট খাও। এবার বলো তো বাছা কী হয়েছে?
আঁ আঁ আঁ …আমার তলোয়ার…অ্যাঁ অ্যাঁ…একটা পাজি বাঁদর… অ্যাঁ অ্যাঁ … নিয়ে নিয়েছে! জঙ্গলের মধ্যে! অ্যাঁ! আমায় ভেংচিও কেটেছে! অ্যাঁ্যাঁ্যাঁ!!!!!!!
বাঁদরের মা তো রাজার মাথায় অনেক হাত বুলিয়ে বিস্কুট টিস্কুট খাইয়ে তাকে শান্ত করল। তারপর মাম্মা বাঁদর, রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি সবাই মিলে জঙ্গলে চলল রাজার তলোয়ার ফিরিয়ে আনতে।
জঙ্গলে গিয়ে দেখে কি, সেই ছানা বাঁদর না, রাজার তলোয়ার দিয়ে গাছ থেকে কলার কাঁদি কেটে নামাচ্ছে। এরা যেই হইহই করে উঠল, সে অমনি মুখ ঘুরিয়ে দেখে, মাম্মা!
ছানা অমনি সব ফেলে একলাফে মায়ের কোলে।
ও মাঁ! খিদে পেয়েছে, বাঈ যাব!
মাম্মা তখন আর বকবে কী, ছানাকে আদর করে কূল পায় না!
তারপর মাম্মা ছানা ট্যাঁকে বাড়ি চলে গেল, গিয়ে ছানাকে চিঁড়ে মুড়কি দুধ কলা দিয়ে ফলার মেখে দিল খেতে, আর রাজা তার তলোয়ার নিয়ে সবাইকে নিয়ে ফিরে গেল রাজপ্রাসাদ। হয়ে গেল গল্প!“
অমনি এই ছানাটাও শেষ চামচ চেটে খেলি করে হুপ্‌ করে এক্ লাফে মায়ের কোলে উঠে পড়ল। তারপর ঘুমু করতে গিয়ে আবার অন্য গল্প…কিন্তু সে আবার পরে আরেকদিন তোমাদের শোনাব।


No comments:

Post a Comment