যে বন্ধুর ভূমির প্রেক্ষিতে আমাদের কাহিনির সূত্রপাত হইতেছে, তাহা এই দেশের অতি
সাধারণ অঞ্চলগুলির একটি মাত্র। নিয়মিত বর্ষণস্নিগ্ধ সে স্থানের মাটি সরস ও উর্বর, বনানীর
নিবিড় সবুজের অন্তরাল হইতে প্রভাতসূর্য উঁকি মারিয়া নিত্য তাহার কোমল রোদের পরশ বুলাইয়া
দিয়া যায়।
এমত এক সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ধরিত্রীর বুকে যদিও অনায়াসে কৃষিমাতৃক সভ্যতা
গড়িয়া উঠিতেই পারত, বস্তুত তাহা হওয়াই স্বাভাবিক ছিল – কোনো অজানা রহস্যহেতু এই জমিতে
অদ্যাবধি একটিও মানুষের পা পড়ে নাই। হয়তো সেই কারণেই, সভ্যতার নিবিড়তম গোপন কথাটি আজিও
অতি কৌতূহলী, মুনাফালোভী বা জ্ঞানতাপস কাহারো কৌতূহলী চক্ষে ধরা দেয় নাই।
কথাটি হইল - এ অঞ্চল জনহীন, কিন্তু প্রাণহীন নয়। এই মানবচক্ষুর অন্তরালে, বসতিশূন্য
অঞ্চলে অখণ্ড প্রতাপে, সানন্দে, স্বচ্ছন্দে ঘুরিয়া বেড়ায় একদল অমিতশক্তিধর জীব।
ডাইনোসর!
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হইলেও এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
এই পৃথিবীরই এক নিরিবিলি নির্জনে, আজিকেও সেই প্রাগৈতিহাসিক প্রজাতির এক অনন্য শাখা অপ্রতিহত গতিতে রাজত্ব করিয়া
চলিয়াছে।
তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তদ্রনুরূপ পরিবর্তিত হইতে হইতে, আদিম জাতভাইদের সহিত ইহাদের
আকারে প্রকারে উল্লেখযোগ্য তফাৎ হইয়া গিয়াছে বইকি! ইহারা আকারে ক্ষুদ্রতর, ইহাদের দৈহিক
গঠন তুলনায় অনেক পেলব ও নমনীয়। প্রাচীন ডাইনোসর হয় সম্পূর্ণ মাংসাশী, নতুবা বিশুদ্ধ
নিরামিষাশী হইত। কিন্তু ইহারা সর্বভুক। সেইসঙ্গে ইহারা বুদ্ধিমান, বলিষ্ঠ, সুকৌশলী,
ক্ষিপ্র এবং সংযমশীল। তবে সর্বাধিক আশ্চর্য এদের শৃঙ্খলাবোধ ও দলবদ্ধতা। ইহারা যখন
যেস্থলে যায়, সকলে একসঙ্গে যায়। সর্বদা সারি বেঁধে চলাফেরা করিয়া থাকে, একজনের কিছুমাত্র
বিপদে অন্যরা সবাই আগাইয়া আসে সাহায্য করিতে। খাদ্যদ্রব্য যাহা পায়, সকলে মিলিয়া ভাগ
করিয়া খায়। সবচাইতে বড় কথা, মনান্তর বা মতান্তর হয় কিনা জানা নাই, কিন্তু হইলেও কখনো
দলমধ্যে কেউ অন্য কারো সহিত বিবাদ করে না।
ইহাদের দেখিলে মাঝেমধ্যে মনে হইবে, সভ্যতার যথার্থ প্রসার মানবসমাজের পরিবর্তে
ইহাদের মধ্যেই অধিক গতিতে হইয়াছে।
আপাতত, দলটি বিক্ষিপ্তভাবে তৃণভূমিতে অলস পদচারণা করিতেছিল। ইহাদের পারস্পরিক ভাব
বিনিময় বোঝার ক্ষমতা যদি আমাদের থাকিত, তাহা হইলে হয়তো বা শুনিতে পাইতাম যে ইহারা আসন্ন
বর্ষাঋতুর নিমিত্ত খাদ্যসঞ্চয় করিয়া রাখা লইয়া আলোচনা করিতেছে।
সহসা বিনা মেঘে বজ্রপাততুল্য এক ঘটনা ঘটিল। আকাশ হইতে তাহাদের মাথার উপর শুভ্র, কঠিন বরফের ন্যায় খণ্ড খণ্ড কী যেন ঝরিয়া
পড়িতে লাগিল। দলের সকলেই প্রথমে এই আকস্মিক আবির্ভাবে ভীত হইয়া দৌড়াদৌড়ি করিতে
আরম্ভ করিয়াছিল, যে যেখানে সম্ভব, উচ্চাবচ ভূমির খানাখন্দে লুকাইয়া পড়িতেছিল
প্রাণরক্ষার তাগিদে।
যেমনই আচমকা এই শ্বেতখণ্ড ধারাপাত শুরু হইয়াছিল, তেমনই আচমকা তাহা আবার থামিয়াও
গেল কিছুক্ষণ পরে। তখন লুক্কায়িত স্থান হইতে এক এক করিয়া আমাদের গল্পের মূল
চরিত্ররা উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল। তৎপরে আকাশে তেমনই নির্ভার নীলিমা, তরুলতাগণ তেমনই
সবুজ সতেজ, চারিদিক তেমনই নিঃশব্দ নির্জন - দেখিয়া দুঃসাহসী কয়েকজন সতর্ক পদক্ষেপে
বাহির হইয়া এল। তাহাদেরই একজন, মুখ তুলিয়া বাতাসে কিসের যেন গন্ধ শুঁকিল।
অতঃপর চকিতে ছুটিয়া গেল অপেক্ষাকৃত নিকটস্থ একটি শ্বেতখণ্ডের দিকে।
এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত, তাহার পর তাহার দিক হইতে দলের বাকিদের প্রতি যে ইঙ্গিত
প্রদত্ত হইল, তাহার ভাষা আমরা না বুঝিলেও সে যে পরম উৎফুল্ল, তাহা বুঝিতে বাকি থাকে
না।
সঙ্গে সঙ্গে প্রবল এক হর্ষের জোয়ার বহিয়া যাইল যেন সেই ভূমিখণ্ডে। সেটা স্বাভাবিকও
অবশ্য, খাদ্য সংগ্রহের ভাবনা শুরু করিবামাত্র যদি এইরূপ শূন্য হইতে খাদ্য বর্ষণ
হয়, কে না উল্লসিত হইবে? যথার্থ, ঐ শ্বেতখণ্ডগুলি এই প্রজাতির ভক্ষণযোগ্য, শুধু তাহাই
নহে, অতি স্বাদু, অতি মনোরম খাদ্য। এই অকল্পনীয় সৌভাগ্যে তাহাদের উচ্ছ্বল আনন্দ, উদ্বেল
চঞ্চলতা দেখে কে!
খণ্ডগুলি অবশ্য আয়তনে তাহাদের শরীর হইতেও বড়। কিন্তু তাহাতে ইহাদের কিছুমাত্র
দমিয়া যাইবার লক্ষণ দেখা গেল না। কেহ একাই, কেহ বা দুইজনে মিলিয়া ধরিয়া, অটুট ধৈর্যের
সহিত ধীরে ধীরে, এক এক করিয়া খণ্ডগুলি তাহাদের গোপন খাদ্যভাণ্ডারে লইয়া যাইতে শুরু
করিয়া দিল। ক্রমে ক্রমে সবগুলিই নির্বিঘ্নে স্থানান্তরিত হইয়া গেছে, আর একটি কি
দুটি পড়িয়া আছে মাত্র, হেন কালে...
“অ্যাই!!! আমার চিনির কৌটো নিয়ে ওখানে কী করছিস?”
“হুশ্! মা, আস্তে! খেতে দিচ্ছি।“
“কাকে আবার চিনি ছড়িয়ে খাওয়াচ্ছ এখন! দেখি?”
জানলার ধাপিতে কয়েকটা গাছের টব। এবড়ো খেবড়ো মাটি, যেমন হয়। মেয়ের পোঁতা ছোলাগাছগুলো
সবে মাথাচাড়া দিচ্ছে। মা মেয়ের পিছন থেকে মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখে সেই মাটিতে একটি দুটি
চিনির দানা তখনো পড়ে, আর ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল কালো কালো ...
“দেখেছ মা? আমি পুষেছি! ওদের নাম কী বলো তো? চিটিসরাস!”
খুবই সুন্দর। আমি তিতিরপাখির মস্ত ভক্ত, ঠিক এই জন্যই ❤️
ReplyDeleteবড্ড ভালো। বড়োই ভালো।
ReplyDeleteআমি তো অনুষ্টুপ শেঠকে তিতিরপাখির জন্যই তিনি।
ReplyDelete