Sunday 12 July 2020

চিঠিচাপাটি

আচ্ছা, আপনারা চিঠি লেখেন? হাতে, পেন বা পেন্সিল দিয়ে, কাগজটাগজে?

না মনে হয়। আমরা কিন্তু লিখি। আমরা মানে আমি আর তিতির। কুট্টি কুট্টি কাগজে, বিলের উলটোবাগে, আমাজনের মোড়ক-ছেঁড়া পিজবোর্ডে, এরকম যাতে হোক অহর্নিশ আমাদের চিঠি লেখালেখি হয়।

উঁহু। পেরাইভেট ব্যাপার বাপু। অমন "দ্যাঁকাও দ্যাঁকাও! বলো বলো!" করে ঝুলে পড়লেই তো আর হল না! বরং চিঠি লেখার টেকনিকটা শেখো।

বার আগে জানতে হবে, উদ্দেশ্যটা কী। মানে এমনি এমনি, নাকি কিছু একটা বায়না সুপ্ত রয়েছে অক্ষরমালার পরপারে, নাকি আড়ির পালা চলছে তাই মানভঞ্জনপ্রক্রিয়া। 

আজ্ঞে। আমরা দুজন, তিতিরের ভাষায়, যাকে বলে পরস্পরের "বেস্ট ফ্রেন্ড"। বললে পেত্যয় যাবেন না তিনি ইদানীং আমায় "ব্রো" বলে সম্বোধন করছেন, কারণ বেস্ট ফ্রেন্ডদের নাকি সেরকম সম্বোধন করাই দস্তুর। ব্যাপারটা পি জে মাস্ক না ইউনিকর্ণ কাদের থেকে শেখা হয়েছে জানি না, কিন্তু তার ফলে আমায় লাগাতার কম"ব্রো"মাইজ করে যেতে হচ্ছে। 

তো, যা বলছিলুম। বেস্ট ফ্রেন্ডরা যেমন গলাগলি করে গল্প করে, চুপি চুপি সব সিক্রেট শেয়ার করে এবং নিয়মিত ব্যবধানে ঝগড়াঝাঁটি করে কথা বন্ধ করে দেয় - আমরাও করি। হ্যাঁ ভাই, জানি আমি বুড়োধাড়ি মাম্মা, তা বলে বুড়িয়ে যেতেই হবে এটা কে বলেছে! কাজেই আমাদের মাঝেমধ্যেই মিনিট দশ বারোর মুখ দেখাদেখি বন্ধ চলে। খানিক খ্যাঁচাখেঁচির পর সাধারণত তিনি দুম দুম করে বগলে পুতুল নিয়ে রাগের চোটে আমার চটি পরেই পাশের  ঘরে চলে যান, আর আমি সাড়ে চারবার ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে নাক টেনে নিজের কাজে মন দিই।  

তারপর হয়তো মন দিয়ে নাক বেয়ে ঝাঁপ দেওয়া চশমা সামলাতে সামলাতে কম্পিতে কাজ করছি, হঠাৎ একটা ভাঁজ করা কাগজ উড়ে এসে কীবোর্ডের উপর পড়ে। ভাঁজ খুলেই দেখা যায় ভাব করার শর্ত এসে গেছে। সাধারণত এক্স সংখ্যক আদর ও হামিতেই ব্যাপার মিটে যায়। তেমন তেমন কেস হলে ললিপপের বা আইসক্রিমের ছবি থাকে। 

আবার কখনো হয়তো এমনি এমনি চিঠি আসে। বি উলটোলে ডি হয়, কিংবা জানলায় একটা কাক বসেছে, এ ধরণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবরও পেয়েছি চিঠি মারফত। আমি নিজেও যে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ খবর-টবর দিইনি তা নয়। এই চিঠি লেখা নিয়ে  বিভ্রাটও যে হয়নি এক আধবার তাও নয়। যেমন ধরুন, এটা বছরখানেক আগের কথা হবে, অসন্দিগ্ধ মা চিঠি খুলে "আই অ্যাম রেস্টিং ইন পিস" পড়ে বিষম টিষম খেয়ে ছুটে গিয়ে আবিষ্কার করেছিল ওটা পিছনে দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে বসে পা নাচাতে নাচাতে "ক্যালভিন অ্যান্ড হবস" পড়ার অবিমিশ্র আনন্দদশার তৈত্তিরীয় ইঞ্জিরি। অথবা, অনেক পাঁয়তারা মেরে চিঠি ভাঁজ করে রকেট বানিয়ে, খাটে বসে থাকা কন্যাকে দরজার আড়াল থেকে ছুঁড়ে সারপ্রাইজ ডেলিভারি করতে গিয়ে সেটা জানলা গলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবার পর মায়ের খেয়াল হয় যে ওই কাগজটার উল্টোপিঠে সদ্য আধ ঘন্টা আগেই রান্নাঘর তদারক করে তিনি মুদির ফর্দটি বানিয়েছিলেন।

কিন্তু কখনো কখনো এরকম পত্রালাপ ভারি বিমূঢ় করে দেয়, জানেন।

এই লকডাউন টাইন নেই যখন, তখনকার কথা এটা অবশ্য। নতুন বাসায় নতুনভাবে সব গুছিয়ে নিচ্ছি তখন। মেয়ের নতুন বড় সাইজের সাইকেল কিনে এনেছি গত সপ্তাহে, আবার গতকালই এসে গেছে তার নতুন পড়ার টেবিল চেয়ার - মায়ের সেটটার হুবহু কপি, খালি রং আলাদা। অফিসফেরত দেখি মেয়ে সেই সাইকেলে হু হু পাক খাচ্ছে বিকেলে, সেই চেয়ার টেবিলে বসে মন দিয়ে ছবি আঁকছে, হোমটাস্ক করছে - আর মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। তো সেদিন রাতে ঘরের আলো নিভে যাওয়ার পর, শুয়ে পড়ার পর, টের পেলুম ছোট্টটা খুব কসরৎ করে ঘুমন্ত আমার বালিশের নিচে কীসব যেন ঢোকাল। পোড় খাওয়া মা হলে যা হয়, টের পেলেও, টের পেতে দিইনি যে জেগে আছি।

পরদিন তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম কথা, "মাম্মা, তোমার বালিশটা উলটে দ্যাখো।"

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বালিশ তুলে দেখি একটা ট্যারাব্যাঁকা ছেঁড়া কাগজ, তাতে লেখা "love and kiss", আর কাল বাড়ি থেকে কাজ করার অনুরোধ, আর একটা ১০ টাকার কয়েন। 

বাকি দুটো তো বুঝলুম। কয়েনটা কেন?

জিজ্ঞাসা করে জানলুম, এই নতুন সাইকেল ও পড়ার টেবিল কিনে দিতে আমার প্রচুর টাকা খরচ হয়ে গেছে নিশ্চয়, তিনি তাই তাঁর পিগিব্যাঙ্ক থেকে বার করে এনে দিয়েছেন...লাগলে আরো দেবেন, আমি যেন একটুও চিন্তা না করি, "আরো আছে মা!"

হাসব না কাঁদব বুঝতে পারিনি জানেন। গলাটা খুব ব্যথা করেছিল খালি। বলা বাহুল্য, ও কয়েন আমার আলমারির লকারে ভেলভেটের বাক্সে তোলা আছে।

2 comments:

  1. আহা! এই মুহূর্তগুলো...। আমার কন্যাটি আমাকে জন্মদিনে তাঁর পিগিব্যাংকের টাকা দিয়ে এককাপ কফি কিনে দিয়েছিলেন, যেটা সন্দেহাতীতভাবে আমার খাওয়া শ্রেষ্ঠ কফি।

    ReplyDelete
  2. তোমরা তো চুমু কম্বো! 😘😘😘😘😘😘😘

    ReplyDelete