Saturday 20 August 2016

শিশুপালন



    রোববারের সকালবেলা, মাছটাছ এনে, তিতিরকে লেখাপড়া করিয়ে, জামাকাপড় কাচতে দিয়ে, বেশ একটা ‘অ্যাচিভমেন্ট’  মার্কা প্রশান্তি মনে নিয়ে সবে চায়ের কাপ নিয়ে বসে কাগজটি খুলেছি কি খুলিনি, সমাধি হয়ে গেল। মানে, ধুপধাপ করে ঘাড়ে পিঠে কোলে গুচ্ছের স্টাফ্‌ড টয় এসে পড়ল, আমি তাদের তলায় সেই E.T.র মত মুন্ডুটুকু বাদে বাকিটা চাপা পড়ে গেলুম
    “দিম্মা! ও দিম্মা!”
    দিম্মা এখন নেই, কলকাতা গেছেন। সুতরাং চোখ তুলে দেখি তিতির ফিকফিক করে হাসতে হাসতে আমাকেই ডাকছে।
    এবার চোখ পাকাতে হল। মেয়ে ফাজিল চূড়ামণি জানি, তাই বলে মাকে দিম্মা বলে ডাকবে!
    তিতিরের তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা, ‘আমি না, আমার বেবিটা ডাকছে তো। তুমি আমার মা না? তাহলে তুমি আমার বেবির দিম্মা হলে তো!’
    হক কথা! আর এহেন প্রোমোশনের পর আর কাগজ পড়ার মত তুচ্ছ কাজ কি করা যায়, বলুন? তাকিয়ে দেখি, বেবিটা একটা ছোট্ট পিঙ্ক টেডি বিয়ার, তাকে আবার অন্য কোন একটা পুতুলের পেন্টু পরানো হয়েছে আর একটা পিচবোর্ডের বাক্সে শোয়ানো হয়েছে। বাক্সশুদ্ধু আমার কোলে ফেলে দিয়ে বেবির মা প্রবল আহ্লাদে সারা ঘর হেলেদুলে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল।
    “তুই অমন লাফাচ্ছিস কেন? মা কখনো ওরকম কিলবিল করে দেখেছিস?”
    “আমি তো পুঁচকে! ছোট্ট আছি না এখনো? বেবির থেকে বড়, কিন্তু তোমার মত বড় তো নই!”
    অকাট্য যুক্তির সামনে পড়ে, অতীব গাম্ভীর্য সহকারে বেবির মুখাবলোকন করা ছাড়া কিছু করার থাকল না। দিম্মা যখন হয়েছি, কিঞ্চিৎ কাজ করে দেখাই, ভেবে তাকে বেশ করে কোলে তুলে দোল দিতে লাগলুম। তিতির ডিভানের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ঠিক একটা মাগুর মাছের মত, ল্যাজের অভাবে পা নাড়াচ্ছিল, আমার এহেন স্নেহময় কর্মে কেন জানি না তার খুব আপত্তি হল। তড়াক করে উঠে বসে বলল, “বেবি ঘুমিয়ে পড়বে তো। এখন ঘুমোলে খাবে কি করে?”
    উফ্‌! দোল থামিয়ে দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করব ভাবলুম। একটা গোল বাটিপানা খেলনা দেখতে পেয়ে সেটা নিয়ে বেশ জুত করে বসেছি, আর ভাবছি, সত্যিকারের বেবিটিকে খাওয়াতে কিরকম প্রাণপাত পরিশ্রম করতে হত..তিতির হঠাৎ দেখি আমার কানের পাশে ফোঁশ ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ফেলছে।
    “কি হল রে?”
    “ঐটা নিয়েছ কেন? ওটা তো বেবির চানের মগ!”
    “অ্যাঁ! এটা তো দিব্যি একটা বাটি!”
    “তো আমার ঐ সাইজের মগ নেই তো। তাই আমি ওটা চানের মগ করেছি। ওটা থেকে কেউ খায়? আর চান করেনি কিছু না, খাবে কেন এখন?”
    হাল ছেড়ে দিয়ে বললুম, “তাহলে কি করব? আমায় ডাকলে কেন?”
আমার ছোট্ট মাতৃদেবীর বোধহয় আমার মুখ দেখে মায়া হল, আমার কোল থেকে টেডিকে তুলে নিয়ে নানাবিধ কায়দায় তাকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করতে লাগল। ঠান্ডা জল হয়ে যাওয়া চা-টা এক চুমুকে শেষ করে আবার কাগজে মন দিয়েছি, বেশ মন দিয়ে পড়ছি, হঠাৎ হাঁউমাউ করে ‘উরি বাবারে উরি বাবারে’ – সেই সাথে টেডি কাগজ ভেদ করে আমার কোলে নিক্ষিপ্ত হল।
আমি তো আঁতকে উঠেছি।
    “কি হল রে?”
    “ইঁহ্‌হ্‌!!! বেবি পটি করে দিয়েছে, তুমি পোষ্কার কর।”
    আমি আপিশ গেলে, তিতিরকে আমাদের মায়ারানী আগলান। তিনি তখন রান্নাঘরে প্রবলবেগে রান্না করছিলেন। এমনিতে, তাঁকে পাঁচবার ডাকলে তিনি আধবার শুনতে পান। এখন, কি করে কে জানে, তিতিরের মুখনিঃস্রৃত ‘পটি’ শব্দটি তাঁর কর্ণগোচর হল। হওয়ামাত্র তিনি খুন্তি টুন্তি ফেলে ঊর্ধবঃশ্বাসে তেড়ে এলেন, “চলো চলো বাথরুমে চলো শিগ্‌গির!”
    বিপন্ন তিতির ও হতভম্ব আমি যতক্ষণে তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে উঠতে পারলুম, ততক্ষণে তিতির বাথরুমের দরজায় পৌঁছে গিয়ে মায়ার সাথে কুস্তি লড়ছে। আমার কথা শুনে, একটা এত ক্ষিপ্র ও এফিসিয়েন্ট এফোর্টের এরকম অপচয় দেখে মায়া ভারী ব্যাজার হয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেল।
    তারপর তিতির আর আমি সোফায় পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসে খুব হাসলুম। আমার কোলে শুয়ে, বিক্কুট খেতে খেতে টেডিও হাসল খুব। বিশ্বাস না হয়, এই দেখ তার ছবি।

 
 

Sunday 14 August 2016

পেঁপেগাছের গল্প



রাত নিঝঝুম। বাড়ির আলো নিভেছে সব।
বিষ্টি বিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু মাথার ওপর ফুল স্পীডে পাখা চলছে, কারণ মশারি খাটানো হয়েছে।
মশারি, মানে ঘরের মাঝে ঘর। তার মধ্যে মা আর পুঁচকেপানা মেয়ে। তার কিলবিল করা আর ফুরোচ্ছে না। একবার মায়ের হাঁটুর ওপর ঠ্যাং তুলে দেয়, তো পরক্ষণেই মুন্ডু দিয়ে কাঁধে গোঁত্তা মারে। নিজের হাতটা নিয়ে তার নতুন অভিনেতার মত সংশয় আছে, কোথায় রাখবে ভেবে পায় না – ফলে নাকে, বুকে, পেটে সর্বত্র থাবড়া খেতে থাকি।
সেই সঙ্গে, সরু সরু গলায় বায়না, “গঁপ্প বঁলো...”
এই অবধি রোজের গল্প। এরপর আমি কোনদিন মরুভূমির (মরুভূমির কথা বলতে গেলেই জনসন আর রনসনকে কেন মনে পড়ে কে জানে!), কোনদিন মহিষাসুরের (এইটা একটা যা-তা  আজগুবী সিরিজ হচ্ছে। বলব পরে কখনো), কোনদিন অলিম্পিক্সের (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সও জানা উচিত, বলুন?) – মানে যেদিন যা মনে আসে সেই গল্প শোনাই তাকে।
আজ একটু অন্যরকম হল।
আমি কিছু বলার আগে, তিতির নিজেই বলে উঠল, “আমার মাথায় আজ প্রচুর ব্যাটারি আছে। ইলেবেন ব্যাটারি। আজ আমি গল্প বলব।”
নিজের সৌভাগ্যে চমৎকৃত হয়ে দু্কান খাড়া করে ফেললুম তৎক্ষণাৎ।
কিসের গল্প বলব?”
“যা খুশি, বল না!”
“না। কি নিয়ে বলব বলতে হবে। এমনি এমনি বলব না।”
মাথা কি আর কাজ করছে তখন! সেই সক্কাল সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি, সারাদিন ধরে আপিশে ঘোড়াড্ডিমে তা দিয়ে, তাপ্পর এক ঘন্টা বাস জার্নি করে এসে, ড্রাইভিং লেসন নেবার নামে ট্রেনারের হৃৎকম্প করিয়ে দিয়ে, সংসারের চাট্টি জিনিস কিনে আর চাট্টি ভুলে গিয়ে, বাড়ি ফিরে তিতিরের হোমটাস্ক করিয়ে, তার সাথে নর্তনকুর্দন করে, ডিনার পর্ব সেরে বিছানায় শোবার পর টুপ করে ঘুমে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না? যাইহোক, ওই যেগুলো আনতে ভুলে গেছি সেগুলোই মাথায় ঘুরছিল তখন। বলে ফেল্লুম, “একটা পেঁপেগাছের গল্প বল দিকি!”
“পেঁ-পে-গাচ!?” সরল চোখে বিস্ময় আর উৎসাহ মায়ের বিদঘুটে বায়না শুনে। দ্যাখ না দ্যাখ গল্প শুরু।
“একটা না, পেঁপেগাছ ছিল। ব-ড়ো পেঁপেগাছ।”
“কোথায় ছিল?” ব্যাগড়া দিয়ে ফেলি।
“ছিল? ছিল হচ্ছে...বলছি...ছিল রিলির দেশে।”
“অ্যাঁ? কোথায় বললি?”
“রিলি দেশে।”
আমার ঘুমকাতর মস্তিষ্ক ধাঁধার গন্ধ পেয়ে সজাগ। এটা কি বাংলা বর্ণমালা চেনার ফল?
“তিতির... ঋ-৯ দেশে? বাংলা ঋ-৯?”
“আরে না! রিলিইই দেশে, যেখান থেকে একটা দিদুন আমায় ফোন করে!”
বুঝে নিই।
“দিল্লি?”
“হ্যাঁ। ঐ রিলি দেশে ছিল তো পেঁপেগাছটা। তো রিলি দেশে না বুঝলে ভয়ানক ঠান্ডা পড়ে। একদম বরফ পড়ে যায় পেঙ্গুইন আর সীলমাছ দের দেশের মত। তাই পেঁপেগাছটার খুব ঠান্ডা লাগে।”
“তারপর?”
“তারপর...এই সব ছোট ছোট বাচ্চা আছে না এখানে? এই আমি, মিহির, বয় সজল, গার্ল সজল, সৌম্যা – আমরা সবাই গেছি ওখানে।”
(সত্যি ই দুটো সজল আছে বাড়িতে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে)
“বেশ তো। গিয়ে কি করলে?”
“আরে ঠান্ডা তো? আমরা বাচ্চারা মোটা মোটা জ্যাকেট পরে গেছি। আর গিয়ে বলছি ‘পেঁপে খাব, পেঁপে খাব’, কিন্তু গাছটায় একটাও পেঁপে হয়নি। ঠান্ডা বলে হয়নি। তাই আমরা খুব বায়না করছি কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। তখন আকাশ থেকে একটা পরী এসে ম্যাজিক করে দিল আর এত এত মিষ্টি পেঁপে হল গাছটায় আর আমরা ইয়াম ইয়াম করে খেয়ে চলে এলুম – হয়ে গেল গপ্পো।”
রেলগাড়ির স্পীডে গল্প শেষ।
“ও তিতির, এটা না খুব ভাল গল্প হয়েছে। এটা আমি লিখে রাখব কেমন?”
“হ্যাঁ। লিখে রেখো না!”
দমাস করে একটা পা এসে পড়ল পেটের ওপর।
“আমি কিন্তু এখন আর গল্প বলতেও পারব না শুনতেও পারব না, আমার ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে।”
এবং বিনা বাক্যব্যয়ে তিনি ব্যাটারি চার্জ করতে লেগে গেলেন, মানে ঘুমিয়ে পড়লেন, আমার একটা হাত ফোনের তারের মত মাথায় ঠেকিয়ে, আঁকড়ে ধরে।

Monday 1 August 2016

আপ্যায়ন


    এই পর্বটার নাম হওয়া উচিত ছিল “‘বাড়িতে গেস্ট ডাকিবার বিপদ’ অথবা ‘নির্‌মাল্লো বধ’”। না না, বধ করে ফেলেনি সেই অর্থে, তবে বশ করেছে বিলক্ষণ।

     নির্মাল্য একটি আদ্যোপান্ত খাসা ছেলে, আমার ভাতৃতুল্য। বেশ কিছুকালের আলাপ, এই ফেসবুকেই এবং তিতিরপাখির গল্পের সূত্রেই, তা সে পাকাপাকি বোম্বের পাট গুটিয়ে পালানোর তোড়জোড় করছে শুনে বললুম, ‘একদিন আসবিনি?’

     আমার এমন স্নেহময় ডাকের টানেই হোক, কি সেই সঙ্গে খিচুড়ি ইলিশভাজার লোভ দেখিয়েছিলুম বলেই হোক, সুবোধ বালকটি ঠিক সময়মত চলে এল এক ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সন্ধেবেলা, সাতিশয় লাজুক লাজুক মুখ করে।

     তারপর টেডি বিয়ারে রূপান্তরিত হল।

     মানে তিতির, এহেন গাবলু গুবলু মামাটিকে, তার খাস তালুকের সম্পত্তি বিবেচনায় সেই যে বগলদাবা করল, ডিনার টাইমে তাকে খেতে না বসানো অবধি আমরা আর নির্মাল্যর সাথে কথা বলার কোন সুযোগই পেলাম না!

     এই অল্পসময়ে নির্মাল্যর কিন্তু প্রভূত শিক্ষালাভ হল, যথা –

     ১) প্লাস্টিকের সাপ দিয়ে কি করে ভয় দেখাতে হয়
     ২) ব্যাঙএর মত কি করে চলতে হয়
     ৩) ন্যাড়ামুন্ডু পাজামা পরা ডলপুতুলকে কি করে কোলে-পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়
     ৪) কিভাবে মায়ের ট্যাবিতে গেম আনতে হয়
     ৫) আটটা বাজলে ঘড়ির কোন কাঁটা কোন ঘরে থাকে
     ৬) কিভাবে হামাগুড়ি দিয়ে চেয়ারের তলা দিয়ে টেবিলের নিচে ঢুকে আবার অন্যদিকের চেয়ারের তলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়

     ইত্যাদি প্রভৃতি।

     মোদ্দা, দুই শিশুর জমেছিল ভাল।

     আমিও অবশ্য কিছু শিক্ষালাভ করলুম। যেমন গেস্টের সাথে কথা বলার আশায় মেয়েকে ট্যাবে খেলার অনুমতি দেওয়া বৃথা। ট্যাব এবং গেস্ট দুই-ই হাতছাড়া হয়ে যায় সে চেষ্টা করলে

তার চেয়েও জরুরি হল, তিতিরকে শেখাতে হবে যে আপ্যায়ন করতে বলা মানে, পিছন থেকে পা টিপে টিপে এসে তার কানের গোড়ায় আচমকা ‘ভালঅঅ করে খাও!!!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠা ন!

যাইহোক, এইসব উৎপাত মামাটি হাসিমুখে সহ্য করল (বলেছি তো ভারি ভাল ছেলে)। তারপর তিতির আর তাকে যেতে দিতে চায় না! খালি বলে, ‘তুমি থাকো, তোমার ছাতাটা বাড়ি চলে যাক!’

শেষ অবধি আমার সাথে নিচ অবধি গিয়ে মামাকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারবে, এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে রাজি হল। তো, লিফটে উঠে দেখি মেয়ের জামার বেল্ট থেকে একটা মাছধরা ছিপ ঝুলছে। জিগ্যেস করাতে তিনি খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে জানালেন যে তিনি কিনা একটু আগে ডগি সেজে ঘুরছিলেন, তাই ওটা তাঁর ‘ল্যাজ্‌’।

ওমা, লিফট থেকে নামার সময় দেখি ছিপটা খুব করে ফ্রকে চাপা দিচ্ছে।

‘কি হল রে?’

‘না বাবা, এখানের আসল কুকুরগুলো যদি আমার ল্যাজ দেখে আমার সাথে ঝগড়া করে?’

তাও তো কথা! সুতরাং ঐ কোঁচড়ে ল্যাজ নিয়েই পেল্লাই চিৎকার করে মামাকে ‘টা টা’ করা হল, তারপর একটাও আসল ডগি দেখে ফেলার আগেই আমরা পাঁই পাঁই করে ঘরে পালিয়ে এলুম।

নির্মাল্যও ওদিকে পাঁই পাঁই করে পরিত্রাহি পালিয়েছিল কিনা সেটা অবিশ্যি জানি না! দেখতে পেলে, জিজ্ঞেস করবেন তো!