এখনো বিষ্টি টিষ্টি পড়ছে তো, মেয়ে ট্যাঁকে করে আমার উইকেণ্ড ভ্রমণে বেশ ব্যাঘাত ঘটছে। এরকম সময়ে জুহু বীচ, চিড়িয়াখানা কি পার্ক টার্কে মোটে যাওয়া যায় না। ইদিকে শপিং মলের গেম জোন গুলোয় মাসে-দুমাসে একবারের বেশী নিয়ে যেতে আমার ভারি আপত্তি। কাজেই তিতিরকে কোথায় বেই-বেই করতে নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়ে ভেবে ভেবে আমার মুণ্ডু খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে।
এমন সময়ে একদিন চেম্বুর মার্কেটে একহাতে আপিশ ব্যাগ অন্যহাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ভীড়ের মাঝে হা-ডু-ডু খেলে বেড়াচ্ছি। জানেন তো এ এমন এক মার্কেট যেখানে সারা বছর পুজোর হাতিবাগান বা গড়িয়াহাটের সমান ভীড় থাকে। তাও তো আজ তুলনায় ফাঁকা, সদ্য গণপতির পালা মিটেছে বলে সবাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। এমন সময়, একটু পিঠ টান করে নেবার জন্য ঘাড় উঁচু করতেই সেই দিব্য বস্তুটি চোখে পড়ে গেল।
আহা, ঈশ্বর স্বর্গে বাস করেন, আর স্বর্গ আকাশের পারে, এসব গল্প আমিও জানি। তাই বলে সাঁঝবেলার বেগুনী আকাশে আমি তাঁর শ্রীমুখ দর্শন করে ফেললুম ভাববেন না। এমনকি তাঁর হাতের জাদুদণ্ড, কি তৃতীয় নয়নের কাজল-মাস্কারা, কি কণ্ঠনিঃসৃত গঞ্জিকাধূম - এসব কিস্যু দেখতে পাইনি।
আমি খালি দেখলুম সারি সারি আখাম্বা পিলার। সেগুলো দেখেই আমার মাথায় আইডিয়ার বাল্ব, বাল্ব কেন ঝাড়বাতি জ্বলজ্বল করে উঠল।
বাড়ি ফিরে মালপত্তর নামিয়েই তিতিরকে পাকড়ালুম।
"মাম্মা, রেলগাড়ি চাপতে যাবি?"
তিনি এখন তিন দাঁতের ফোকলা। ভুবনমোহিনী হাবলা হাসি হেসে বললেন, "কু ঝিক ঝিক রেল? ও মা, কু ঝিক ঝিক করে কলকাতা যাব? বদ্দিদা ছোদ্দিদা মাসিমণি যাব?"
টুক করে একটা বুকভাঙা নিঃশ্বাস চেপে ফেলি। সে যে কবে যাব আবার কে জানে!
"না মাম্মা, সে পরে, এখন তোমার ইস্কুল আছে না? এখন এখানেই, এমনি একটা রেলগাড়ি চাপবি?"
এই রে, ভ্রূ কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় যে! এর আগে একবার মোনোরেল চাপানো হয়েছিল বটে, তার সে অভিজ্ঞতা, প্রথম পার্টটা অন্তত মোটেই সুখকর নয়। যাবার পথে আলাদা বসানোয় সারা রাস্তা কেঁদেছিল ভেউ ভেউ
করে। ফেরার পথে অবশ্য মা দিম্মা সবার সাথে বসে মজা করতে করতেই ফিরেছিল। কে জানে কতটুকু মনে আছে!
"শোন না, এটা খুব মজার রেলগাড়ি। মাটি থেকে অনেক উঁচু দিয়ে যায়। আর একটা মোটে রেলের লাইন, তাই এটার নাম মোনোরেল।"
"পড়ে গেলে?"
"কে পড়ে যাবে? ট্রেন? না না সে লাইনের সঙ্গে চেপ্পে আটকানো রে। পড়ে না।"
"আমি পড়ে গেলে?"
"তুই তো ট্রেনের ভিতরে থাকবি। পুরো বন্ধ ট্রেন, কাচের জানলা। পড়বি কোদ্দিয়ে?"
"ট্রেনে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলে? ট্রেনের ভিতরে পড়ে গেলে?"
"আমার হাত ধরে থাকবি। পড়তে দিলে তো পড়বি।"
সাধে কি বলি ফক্কড় চূড়ামণি অজুহাতের গাছ! তিনি ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে হাসতে বলেন, "আর তুমি পড়ে গেলে?"
এইবার গোঁসা হয়ে বলি, দ্যাখ বাপু যাবি তো কাল চ', নইলে ঘরে বসে চাইনিজ চেকারের ঘুঁটি দিয়ে একা একা সাপলুডো খ্যাল। বা জিগ-স পাজলের টুকরো দিয়ে পেশেন্স-ও খেলতে পারিস। মোদ্দা আমি আর কিছু বেড়ানোর জায়গা ভেবে পাচ্ছি না, আর ইয়ে, মোনোরেল স্টেশনে খাসা এস্ক্যালেটরও আছে দেখেছি।
সুতরাং পরদিন শুভ বিকেলের আনন্দ সঙ্গে নিয়ে (দেখুন, প্রতিদিন নাহোক সাতখানা শুভ সকাল আর শুভ রাত্রি আসে ইনবক্সে। সেই সঙ্গে জীবন বৈচিত্র্যময় করতে শুভ দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কিছুই বাদ যায় না! আমার ইচ্ছে আছে এদের ধরে ধরে 'শুভ বারবেলা' আর 'শুভ ব্রাহ্মমুহূর্ত' পাঠাব কোনোদিন, নেহাত সময়মত খেয়াল হয় না তাই!) সেজেগুজে তিতির, আমি আর তিতিরের আন্টি বেরিয়ে পড়লুম মোনোরেল ভ্রমণে।
তিতিরের উৎসাহ দেখে কে! লাফাতে লাফাতে গিয়ে আমার সাথে টিকিট কাটল, আহা বেচারির নাকটুকু কোনরকমে কাউন্টারের লেভেল পৌঁছল গো, অমন কাতর চোখে তাকালে কোলে না নিয়ে কি করি! তাপ্পর সেই রংচঙে গোল প্লাস্টিকের চাকতি দেখে তো তিতির আর তিতিরের আন্টি হেসে খুন। এ রকম আবার টিকিট হয় নাকি! আমায় নিঘঘাৎ ঠকিয়েছে। তিতির তো তিনটেই পকেটে পুরে ফেলল সটাং, বাড়ি গিয়ে খেলনার ঝুড়িতে রেখে দেবে।
গেটের কাছে পৌঁছে, বলে বুঝিয়ে আর পাঁচজন কেমন ওই চাকতি ঠেকিয়ে গেট পার করছে তা দেখিয়ে তো উদ্ধার করলুম সেগুলো। তারপর ওপারে যেতে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক। এটায় তিতির ওস্তাদ, প্লেনের আন্টিরা সাধারণত ওকে আবার আদর করে গাল টিপে দেয়, কাজেই সে দু হাত ছড়িয়ে বুক চিতিয়ে ফোকলা হেসে দাঁড়িয়ে পড়ল। এখানের আন্টি বোধহয় উল্টোটা দেখে অভ্যস্ত, কেমন ঘাবড়ে গিয়ে 'ঠিক হ্যায় ঠিক হ্যায়' বলে ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। আমায় কিন্তু ছাড়লেন না, আমার যে কি 'ভুল হ্যায়' ছিল কে জানে!
তাপ্পর আবার একটা মিনি এস্কালেটরে চড়ে প্ল্যাটফর্ম। দিব্যি হলুদ লাইন টাইন দেওয়া। কত ইস্কুলের বড় বাচ্চা কিলবিল করছে। দ্যাখ না দ্যাখ ট্রেন এসে গেল। কচি কলাপাতা রঙের ছ কামরার ট্রেন। পুটুস করে দরজা খুলল, আর আমরা উঠে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বসার জায়গা ছিল না বলেও বটে, বেশি ভাল দেখা যাবে বলেও বটে।
দেখুন, একে তো সটাং পায়ের অনেক নীচে রাস্তা ঘর বাড়ি গাড়ি দেখা যায় এট্টু এট্টু গা শিরশির করেই, তায় যাবার পথে বাঁক নেবার সময় ট্রেন বেশ খানেকটা কাৎ হয়ে পড়ি-পড়ি ভাবটা আরো বাড়িয়ে দেয়। ছোট্ট মেয়ে তাতে যদি মাকে দুহাত দিয়ে সর্বশক্তিতে আঁকড়েই রাখে, তাহলে অমন হাসির কি আছে শুনি? ও তো মোটেই ভয় পায়নি, মা যাতে ভয় পেয়ে পড়ে না যায় তাই তো ধরে রেখেছিল!
চেম্বুরে নেমে, ফুচকা আখের রস এসব দেবভোগ্য খাবার খেয়ে, একটা স্পাইডারম্যান বেলুন নিয়ে বাড়ি ফেরা তো হল। ও বাবা, পরদিন এসে শুনি তার বেজায় সাহস হয়েছে! দাদু দিম্মার সাথে আজ আবার - এই ভুল বলছি, দাদু দিম্মা আজ তিতিরের সঙ্গে মোনোরেল চেপে আজ এদিকে চেম্বুর, তারপর উলটোদিকের পথে বড়ালা গেছিলেন ঘুরতে। দেখি খুব দিলখুশ, তিড়িং তিড়িং লাফাচ্ছে সে।
"কি খেলি রে মাম্মা বড়ালা গিয়ে? বড়া?"
না। তিতির বড়া খেয়েছে। ডালবড়া। কিন্তু সেটা চেম্বুরে।
"বড়লায় কিছু খাইনি! মোট্টে খাবে না ওখানে, বুঝলে।"
"কেন রে?"
"আহহহহ! দেখছো না কেমন নাম, বড়লা? ওখানে খেতে গেলেই খালি করলা খাইয়ে দেবে ধরে, তখন বুঝবে!"
No comments:
Post a Comment