Monday 27 November 2017

পাহারাদার



   সেই যে আগের বার বললুম, তিতির আর আমি খুব মজা করে মিউজিয়াম দেখে এলুম? তাপ্পর না, সেখান থেকে বেরিয়ে তিতিরকে জোর সারপ্রাইজ দিলুম। মিউজিয়ামটা হচ্ছে জিজামাতা উদ্যানের এক পাশে। আর এই জিজামাতা উদ্যানেই আছে মুম্বইয়ের একমাত্র ম্রিয়মাণ চিড়িয়াখানাটি।
ম্রিয়মাণ না বলে উপায় নেই, কারণ কলকাতার চিড়িয়াখানার পাশে এটা নস্যি। যেসব বাঘা বাঘা জন্তু জানোয়ার দেখার লোভে লোকে চিড়য়াখানা যায়, সেই বাঘ সিংহ ভাল্লুক গণ্ডার জিরাফ গরিলা ওরাংওটাং কিছুই নেই এখানে। খালি কয়েকটা হাতি, কুমীর, বাঁদর, হরিণ আর কিছু পাখপাখালি, এই নিয়ে টিমটিম করত এদ্দিন। কিন্তু এখন, এখানে এমন কিছু আছে যা ভারতের আর কোন চিড়িয়াখানায় নেই!
পেঙ্গুইন!
এদের বাসস্থান বানানোর চক্করেই, গোটা চিড়িয়াখানা ঢেলে সাজানো হয়েছে। আগে বহুবার এলেও, সারিয়ে সুরিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে ভোল পালটে এমন বাহারী হয়েছে যে তিতির প্রথমে চিনতেই পারেনি কোথায় যাচ্ছে। গেট পেরোনোর পর চেনা পেয়ে আহ্লাদে চারপাক ঘুরে গেলো ফ্রকের কোণা ধরে, "হাতি দেখব ও মাম্মা হাতি দেখবো!"
হাতিটা বেশ কান ন্যাজ নাড়াচ্ছিল। তাই দেখে সদ্য শেখানো ছড়া আউড়ে দিল তিতির,
"হাথী রাজা, বহুৎ বড়া,
শুঁড় উঠাকে কাঁহা চলি?
পুছ হিলাকর কাঁহা চলি?
মেরে ঘরপে আও না
মিঠে গন্নে খাও না!
আও বিঠায়ে কুর্শি পর
কুর্শি বোলে, চটর পটর চটর পটর!"
(আমার দুঃখটা খালি ভাবুন মশাই! নিজে জীবনে হিন্দি পড়িনি। এখন স্কুলের কম্পিটিশনের জন্য নেট ঘেঁটে শুধু যে এসব শিখতে হচ্ছে তাই না, হাত পা নেড়ে মেয়েকে শেখাতেও হচ্ছে!)
তারপর আমরা কত কিছু দেখলুম। বাঁদরের টায়ার ধরে দোল খাওয়া, কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি, অজগর সাপ, জল থেকে উঠে প্যারেড করে বেড়ানো মা হিপো আর বেবি হিপো, হরিণের দল, এমু পাখির ডিম।
তারপর পেঙ্গুইন।
আমরা আগেও পেঙ্গুইন দেখেছি লণ্ডনে। এটা সেরকম ধাঁচেই বানানো। (সব শহরেরই লণ্ডন হবার একটা ন্যাক থাকে বুঝলেন।) কাচের ঘর, তার মধ্যে বরফ ও জল দিয়ে পেঙ্গুইনদের বাসস্থান। পাঁচটা পেঙ্গুইনদের কেউই জলে নেমে সাঁতরাচ্ছিল না, বরং বরফের ওপর দাঁড়িয়ে প্রবলবেগে পরস্পরের গা চুলকোচ্ছিল।
আশ মিটিয়ে পেঙ্গুইন দেখে বেরিয়ে ফিরতি পথে আবার চমক। প্লে এরিয়াটাও ঢেলে সাজিয়েছে। চমৎকার সব এমনি স্লিপ, গড়গড়ে স্লিপ, এঁকাবেঁকা স্লিপ, সুড়ঙ্গ স্লিপ - আমারই চাপার শখ হচ্ছিল! বেরসিক গার্ড আঙ্কল বাঁশি বাজিয়ে টাইম-আপ না করে দিলে তিতির মাকে নিয়ে সারারাতই বোধহয় ওখানে থাকত।
বেরিয়েই লাল টুকটুকে বেলুন ওলা। চ্চাঁই চ্চাঁই চ্চাঁই...
দাঁড়া বাপু। এখন খিদে পেয়েছে খেয়ে নিই আগে। বেলুন নিয়ে খেতে যেতে পারলুম না, ফেরার পথে দেব।
একটা খাসা বেকারি আছে কয়েক পা দূরেই। পথে ফুটপাথে পসরা নিয়ে বসেছে পুতুল-ওলা। গুলুগুলু চোখের পুতুল, চাবি দিলে গুটগুট করে হামা দেয়। তিতির কাতর চোখে তাকায়, আমি উদাস ভাবে ব্যাগ থেকে টাকা বার করি।
তিতির মাফিন খায়, জুস খায়, মায়ের চিকেন পাফ এর খোলসটা খায়, ব্রেড পুডিং 'টেস' করে দেখে। পুতুল টেবিলে হামা দেয়। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে হুশ করে বাড়ি।
পরদিন তো আবার যেমন হয় রোজ রোজ। তিতিরের ইক্কুল, মায়ের আপিশ। তিতিরের আবার ইংলিশ এক্সাম। চুপিচুপি মাকে বলে একটা পুঁচকে পক্ষীরাজ ঘোড়া স্কুলের ব্যাগে ঢোকায় সে, সঙ্গে খেলনা থাকলে নাকি সেটা ওকে পাহারা দেয়।
পিঠে ব্যাগ, ব্যাগে মিনি মাউস জলের বোতল, হাতে পরীক্ষার বোর্ড - বন্ধুদের সঙ্গে কলকল করতে থাকা মেয়েকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে মা আপিশ আসে। ফোনে চার্জ কমে গেছে, ব্যাগ খুলে চার্জার বার করতে গিয়ে দেখে –
পিঙ্ক বো, গুলুগুলু চোখ, খালি গায়ে পিঙ্ক পেন্টু পরা হাসিমুখ।
কালকের সেই হামাগুড়ি দেওয়া পুতুলটা।
মনে পড়ে যায়, পুতুলটা কিনে হাতে দেবার পর, কাছ ঘেঁষে এসে, আদর ভাসাভাসি গলায় মেয়ে বলেছিল, “আর বেলুন কিনো না তাহলে মা, এই তো একটা খেলনা দিলে!” মেয়ের বুঝদার আচরণে মায়ের বুকে খুব লুকোনো একটু গর্ব হয়েছিল বলতে কি!
সেই একই মমতা থেকে, নিজের ব্যাগে খেলনা নেবার সময়ে মায়ের ব্যাগেও নতুন খেলনাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে ছোট্ট মেয়ে। তার মাকে পাহারা দিতে।
আস্তে করে পুতুলটা কম্পির পাশে নামিয়ে রাখি। চোখের কোণ জ্বালা করে। আমার আসল পাহারাদারটি যে ‘সিক্স ইইরস ওল্ড’ হয়েই এত্ত বড় হয়ে গেল!


No comments:

Post a Comment