"এই দ্যাখ, সীমগুলো বড় বড় তো, তাই প্রতিটা সীম পাঁচ টুকরো করলুম, বুঝলি! আমার কাছে ১১ টা সীম ছিল, তা সব পাঁচ পাঁচ করে কেটে দেখি দুটো টুকরো দাগ ধরা, ফেলে দিলুম। বল তো কটা রইলো?"
দিম্মার রান্নাঘরে সীম ছেঁচকি রান্না হচ্ছে। আমি এ ঘরে বিছানা তুলতে তুলতে উৎকর্ণ হই। জানি মহিলা প্রেসিডেন্সির স্ট্যাটিসটিক্স, তারপর আই এস আই এর এম টেক।
এও জানি যাঁর সঙ্গে ঘর করেছেন জীবনভর, মানে আমার পিতৃদেবও তাই। তাই বলে,
তাই বলে এইভাবে গুনেগেঁথে সীম ছেঁচকি রাঁধবেন? ইয়ের একটা সীমা পরিসীমা থাকে!
"ফাইব থী ফিফটি থী।"
রিনরিনে গলায় উত্তর আসে। টুক করে মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখে নিই, মেয়ের হাতে খাতা পেন্সিল নেই বটে। অ, মানসাঙ্কের ক্লাস চলছে দিম্মার রান্নাঘরে।
"এইবার, খেতে বসে না তিতিরের মাম্মা বলেছে তার পঁচিশ টুকরো সীম চাই, চাই তো চাই, চ্চাঁই চ্চাঁই চ্চাঁই!"
হেব্বি রাগ হয়। আমি খেকো বলে এমন কথা আমার নামে? রাগের চোটে চেয়ারটাকেও ঝপাং
ঝপাং করে ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে দিই দু’ঘা।
"তো, মাকে পঁচিশটা দেবার পর যা রইল, সেটা তিতির আর দিম্মা হাফ হাফ খেল। বল তো দিম্মা ক টুকরো নিল?"
রাগটা কেমন গরম হাওয়ায় আইসক্রীমের মত গলে গলে যায়। মনে পড়ে জীবনে কোনদিন অঙ্কে ভয়
যে কী বস্তু বুঝতে পারিনি। কোনদিন না। ইতিহাস পড়তে গিয়ে সাল তারিখ নিয়ে ক্লান্ত হয়েছি, কেমিস্ট্রি চিরকাল বোরিং ব্যাপার মনে হয়েছে, ভূগোল ক্লাসে কখনো কখনো হাই উঠেছে। কিন্তু এই "অঙ্ক! ওরে বাবা!" ব্যাপারটা কিছুতেই ধারণায় আনতে পারিনি।
আজকাল আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি, কেন।
ওদিকে তিতির প্রবল ভ্রূ কুঁচকে কড় গুনছে। পড়ে ক্লাস ওয়ানে। আজকালকার সিলেবাস অনুযায়ী তারা এখনো দুটো সংখ্যা যোগ বিয়োগের ওপরে ওঠেনি। তবে সে তো স্কুলের খাতার পাতায়!
"ফোট্টিন!"
এবার আমারও যোগদান করার বাসনা হয়। ততক্ষণে বিছানা সেরে ঝাড়ন ধরেছি। টিভি স্ট্যাণ্ডের ধুলো মুছতে মুছতে বলি, "এই আমাকেও একটা অঙ্ক বানিয়ে দে।"
প্রচুর হি-হি-খিলখিল হচ্ছে শুনতে পাই। মাকে অঙ্ক বানিয়ে দিতে দিম্মা নির্ঘাৎ 'হেল্প' করছে।
"ওই ক্যালেন্ডারের দাদুটার না...২৩৭ টা দাড়ি আছে।"
দেওয়ালে গত বছর পিকনিকে সুকুমার রায় ক্লাবের দেওয়া ক্যালেন্ডার। তাতে সেই হ-য-ব-র-ল এর 'উদো'র ছবি, পা অবধি লুটোনো দাড়ি সহ। হাসব না ভেবে গম্ভীর থাকা খুব কঠিন। খুব।
"তার মধ্যে ১৭ টা দাড়িতে উকুন হয়েছে এঁ হেঁ হে হে হে হে..."
অঙ্ক টীচার নিজেই হেসে গড়াগড়ি তো আমিই বা বাদ যাই কেন!
"প্রতি দাড়িতে তিনটে করে উকুনের ডিম থাকলে বলো তো টোটাল কটা ডিম আছে? আর কটা দাড়ি ভালো আছে?"
যত্তসব ইয়ের দল! আমার বেলায় কেমন ছিরির অঙ্ক দেখুন। আমার তো আবার শোনামাত্র মানসচক্ষে দেখে ফেলা স্বভাব, চোখের সামনে উদোর টেকো মুণ্ড দেখতে পাই, খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে দাড়ি চুলকোনো দেখতে পাই, এমনকী তারপর জুম করে উকুনদের ছুটোছুটি অবধি দেখতে পেয়ে যাই।
তারপরই খটকা লাগে।
"এই, প্রতি দাড়ি মানে কী? উকুনরা কি শুধু সেই ১৭ টা দাড়ি, মানে যেখানে তারা বসবাস করে সেখানে ডিম পেড়েছে? নাকি সেগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলোয়? নাকি সবকটা দাড়িতেই?"
এত বেমক্কা জটিলতা তিতির ভাবেনি। ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন হয়ে যায় কাঁচুমাচু মুখে। কিন্তু তা বললে তো হবে না, আমি বলে আই টির লোক, স্পেসিফিকেশন একদম কিলিয়ার না হলে তো কোডে হাত লাগাব না মশাই!
তিতির দিম্মার সঙ্গে কন্সাল্ট করে এসে বলে, না শুধু ওই ১৭ টাতেই ডিম পেড়েছে।
কিন্তু ততক্ষণে আমার জ্ঞানস্পৃহা চাগিয়ে উঠেছে। দাড়িতে কি আদৌ উকুন হয়? হওয়া সম্ভব? এটা
আমার নিজের পক্ষে জানা অসম্ভব কারণ আমার তো কস্মিনকালেও দাড়ি ছিল না! এমনকী আমার পিতৃদেবেরও ছিল না। ইন
ফ্যাক্ট চেনা পরিচিত একজনকেও মনে পড়ে না যার আছে। তাহলে কোন দাড়িয়ালকে ধরে জিগাই?
অবশ্য পরশুরামের
গল্পে, দুর্বাসার দাড়িতে উকুন ছিল বটে। তাহলে পসিবল, হাইলি পসিবল।
এসব গবেষণা করতে করতে ঝাড়াঝুড়ি শেষ করছি, তিতির শুনি রিপোর্ট করছে,
মা না অঙ্ক পারে না! দ্যাখো এখনো বলতে পারছে না!
রেগেমেগে গোঁ গোঁ করে উত্তর দিয়ে দিই। দিয়ে ঝাড়ন রেখে পাজামা ছেড়ে
পাৎলুন গলাই, ভারী গলায় বলি, “দাও দাও থলি দাও দিকি, মাছ ফুরিয়ে যাবার আগে
বাজারটা সেরে আসি!”
কি করে টের পায় বলুন তো গোঁসা করেছি? অমনি ছুট্টে এসে হাঁচড় পাঁচড়
করে কোল বেয়ে উঠে গালে কপালে হামি দেয় আর বলে এই দুটো হামি দিলুম ( বলে তিনটে দেয় ),
এই আরো তিনটে হামি দিলুম ( বলে পাঁচটা দেয় ), বলো তো তিতির মাম্মাকে টোটাল কটা হামি
দিল?
আর আমি হামি মাখামাখি মুখে বেভুল হাসি হাসতেই থাকি, কিচ্ছু উত্তর
মাথায় আসে না…
নাঃ, ঠিকই বলেছে মেয়েটা, মা একদম অঙ্ক পারে না!
No comments:
Post a Comment