যেই একটু নিজের কাজে বসব, অমনি অবধারিতভাবে ছোট মানুষটির আগমন ঘটবে। হুস করে ঢুকে
হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে হুস্-তর গতিতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল,
“মাঁ! গণেশটা কী সুন্দর এঁকেছি না? পরশুরামও আছে।“
সে তো দিব্যি নাচতে নাচতে পালাল, আমি এদিকে কাগজটার এপিঠ ওপিঠ আগাপাস্তলা খুঁজে
ট্যান খেয়ে বসে রইলুম। ওপিঠে কিস্যু নেই, এপিঠে দিব্যি নধর গণুবাবা আছেন, তাঁর মাথায়
মুকুট, হাতে কুঠার, সামনে লাড্ডুর থালা, পায়ের কাছে পুঁচকে ও মিচকে ইঁদুর সব আছে, কিন্তু
সেই ক্রোধী মুনিটি কই? তাঁর জটার একগাছা চুলও তো দেখতে পাচ্ছি না!
ইতিমধ্যে লাট্টুর মত
পাক খেতে খেতে তিতির পুনঃপ্রবেশ করেছে।
“অমন ঘুরপাক খাচ্ছিস
কেন, পড়ে যাবি যে!”
“আমি এখন আথ্! আথ্
এমনি করে চলে।”
বড়ই ভাবনার বিষয়। খাটের
পাশের অপ্রশস্ত জায়গায় আহ্নিক গতি হতে থাকলে আমি যাই কোথায়!
আমার চিন্তা টের পেয়েই
হয়তো তিতির আশ্বস্ত করল,
“তোমায় একটা কথা বলতে
এলুম খালি!”
ভনিতা করছে মানেই
গড়বড়, কিছু উৎপটাং বায়না আসছে মনে হয়। তড়িঘড়ি কথা ঘোরাই,
“হ্যাঁ রে, তোর পরশুরাম
কই?”
সলজ্জ হাসি সহযোগে
উত্তর এল, “ওটাই তো বলতে এলুম! ভুল বলেছি, পরশুরাম নয়, পরশু। গণেশের হাতে আছে।"
বেচারি! প্রবাসে বড়
হয়েও বাংলা শব্দভাণ্ডার তার এত বড়সড়, গুলিয়ে গেলে কী আর করা! বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি
এবং মারাঠী নিয়ে জাগলারি করতে হলে অমন একটু আধটু হতেই পারে। নাহয় এখনো ‘ফেব্রিক
কালার’কে সমানে ‘ফাইব্রাস কালার’ বলে যাচ্ছে, এই কিছুকাল আগেই আমাদের সে খাবার ‘সার্ভাইভ’
করে দিতে চেয়েছিল – তাই বলে পরশুকে পরশুরাম বলে ফেলেছে বলে হাসব নাকি! শব্দটা জানে
এই না কত!
এইসব বিবেচনা করে খুব
গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছিলুম, হাসিটাকে গালভরা পানের মত একবার এদিক একবার ওদিক করছি,
হঠাৎ খেয়াল হল হোমটাস্ক বাকি আছে।
কম্পি টম্পি ফেলে হাঁক
পাড়লুম, “ওরে ল্যাবেঞ্চুশ, বলি সারাক্ষণ ছবি আঁকলে আর নেত্য করে বেড়ালেই চলবে? শিগগির
বইখাতা নিয়ে আয়!”
গতিজাড্য খুব খারাপ
জিনিস বুঝলেন? ওতে গালে হামি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কচি মাথার গুঁতোয় চশমাও নাক থেকে
খসে পড়ে যায়।
যাইহোক। পনেরো মিনিট
পরের দৃশ্য।
খাটে বইখাতা ছড়ানো।
মেয়ে ছোট টেবিল পেতে লিখছে। মা অতি বিপন্ন ভাবে নেট হাতড়াচ্ছে।
মায়ের হিন্দির যা অপূর্ব
দক্ষতা, নেট না হাতড়ে উপায়ও নেই। দিম্মা থাকলে তিনিই করান এই সাবজেক্টটি, তিনি
একদা স্কুলে হিন্দি পড়েছেন, কর্মসূত্রে বলেওছেন বহুবার, মায়ের চেয়ে অন্তত ভালো
জানেন। দাদুমণির হিন্দি শোনার অযোগ্য ভয়াবহ, অতএব মায়ের আপাতত গুগলঠাকুর ভরসা।
ক, কা, কি... ইত্যাদি
দিয়ে শব্দগঠন ছিল। দিব্যি চলছিল, ঠেকে গেল ‘ঃ’তে এসে।
তিতির যেই না নাকের ডগায়
চশমা ঠেলে প্রবল সিরিয়াস মুখে বলেছে, “কঃ!” অমনি আমার ‘দ্রিঘাংচু' মনে পড়ে গেছে! তারপর
না হেসে পারা যায়? হাসামাত্র ওদিক থেকে কৈফিয়ত তলব, “হাসছ কেন, হাসছ কেন?” তখন ছোট্টটাকে
বলতেও হয় গল্পটার কথা, তারপর দুজনে মিলে জাপটাজাপটি করে হেসে কুটিপাটি হতেও হয়,
তারপর রাত্রে আসল গল্পটা পড়ে শোনাব কথাও দিতে হয়, তারপর দেখা যায় সর্বনাশ সমুৎপন্ন হইয়াছে।
কঃ দিয়ে আমি কোনো শব্দ
জানি না। কোনোই না।
এদিকে তিতির ‘আমার মা
সব জানে’ গোছের মুখ করে চেয়ে আছে।
কী আর করি, লেখার সময় শব্দ
ভেবে না পেলে যা করি, তাই সাজেস্ট করলুম।
“চ, বার বার বলে দেখি,
ঠিক মাথায় কিছু না কিছু এসে যাবে।“
আরো মিনিট দশ পরের দৃশ্য।
মা আর মেয়ে মুখোমুখি বসে “কঃ?” “কঃ!” করে যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে, দাদুমণি আর আন্টি
উঁকি মেরে দেখে পালিয়েছে। এমন সময়ে ডাকাডাকিতে আকৃষ্ট হয়ে নাটকের পরবর্তী কুশীলব
জানলায় এসে বসল, তারপর সেও আমাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘ক্কঃ!’ ‘ক্যাঁঃ’ করতে লেগে
গেল।
কে জানে সেটা কাক না
দ্রিঘাংচু!