Tuesday 6 December 2016

ভারতমাতা


ফ্যান্সি ড্রেস নিয়ে প্রতি বছর কি যে ফ্যাসাদে পড়ি সে আর কহতব্য নয়। আরে ঐ যে বচ্ছর বচ্ছর ইশকুলে হয় গো? যাতে সারি সারি গলায় স্টেথো মিনি-ডাক্তার, টপ হ্যাট ম্যাজিশিয়ান থেকে শুরু করে গাউন নিয়ে লটপট করা ব্যক্তিত্বময় বিবেকানন্দ, ক্ষীণতনু চার্লি চ্যাপলিন থেকে আরম্ভ করে নাদুশনুদুশ কেষ্টঠাকুর, আর মেয়েমহলে পিঠে ডানা হাতে জাদুদন্ড পরী, নাকে নথ বালিকা বধূ থেকে আদি নীল-সাদা শাড়ির হকদার মাদার টেরিজা অবধি ঘুরে বেড়ায়, স্টেজে উঠে ভাষণ দেয় তবে সুখের কথা তিতির কিনা এখনো বাচ্চা, ওদের শুধু স্টেজে উঠে একটা পোজ দিয়ে দাঁড়ালেই চলে, কিছু বক্তব্য পেশ করতে হয় না।
    কিন্তু পোজ দিতে হলেও তো কিছু একটা সাজতে হবে? ধরে নাও আমি একটা জিবেগজা, কি ইলেকট্রন, কি মিসিং লিংক – বলে দাঁড়িয়ে পড়লেই যদি ল্যাঠা চুকে যেত! আচ্ছা কেন যায় না বলুন তো, আমি তো দিব্যি ‘এই মনে কর আমি একটা গাছ’ বলে হাত টাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি, আর তিতিরও দিব্যি ‘আর আমি একটা কুইরেল’ বলে তর তর করে ভুঁড়ি বেয়ে কোলে উঠে পড়ে। কিংবা তিতির বলে ‘মনে কর আমি একটা চিতাবাঘ’, আমিও অমনি দেখতে পাই গায় চাকা চাকা দাগওলা এক অতি বিচ্ছু ছানা-চিতা, রাজকীয় চালে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে, ল্যাজের ডগাটা একটু একটু নড়ছে, এমনকি বেঘো গন্ধটাও নাকে পেয়ে যাই। কিন্তু তিতিরের ক্লাসের ছানাপোনাগুলো যদি বা এসব দেখতে পারে, তাদের বাবা মা বা টীচাররা দেখতে পাবেন আশা করা বাতুলতা।
অগত্যা মেয়েকে বেশ একটা খোলতাই দ্রষ্টব্য কিছু রূপ ধারণ করাতে হবে – মানে ভেবেচিন্তে চরিত্র চিত্রায়ন থেকে নাট্যরূপ প্রদান, মায় ফার্স্ট (ও একমাত্র)এডিশন পাবলিশ করা অবধি সব আমার আর তিতিরের দিম্মার হোমটাস্ক! দু সপ্তাহ ধরে দুজনে প্রাণ ভরে মস্তক ঘর্মাক্ত করতে লাগলুম, আর তিতির প্রতিদিন নতুন নতুন দাবি করতে লাগল। তার অনেকগুলোই খারাপ না, কিন্তু ঐ যে আমার মাথায় ক্যারাপোকা এবং বাজারে কিঞ্চিৎ ক্রিয়েটিভ বদনাম আছে, যেটা সম্বন্ধে আবার কোন পাপের ফলে কে জানে তিতিরের টীচার মহলও ওয়াকিবহাল, ফলে চেনাজানা ‘প্রজাপতি’ (খুব সহজ বানানো, রেডিমেড ডানা, অ্যান্টেনা সব আছে), ‘ফেয়ারি প্রিন্সেস’ (ওই ডানা দিয়েই চলবে, আর জুহু থেকে কেনা পেন্সিলের মাথায় স্টার, আর কাগজ কেটে মুকুট) বা ‘রাধা’ কি ‘মীরাবাই’ (সেম ঘাগরা মেকাপ আর কান্নিক মেরে চুল বাঁধা, খালি একটু গয়নাগাটির রকমফের ব্যাস!) করতে তো মন চাইছে না!
ফলে কিছুদিন এই চলল -
“ক্যাটারপিলার! মা আমি ক্যাটারপিলার হব!”
সবুজ চার্টপেপার কিনতে হবে তাহলে, গোল গোল কেটে বডি, কালোও লাগবে, পা আর শিং বানাতে হবে, কিন্তু পিছনে বোর্ড না দিলে কি শক্তপোক্ত হবে? আর ক্যাটারপিলার স্টেজে কি পোজ দেবে? চাট্টী ফুলকপির পাতা ধরিয়ে দেব নাকি হাতে?
ভাগ্যিস কিনে ফেলিনি। পরদিনই মেয়ের মন পালটে গেল।
“আমি ডাক হব মা! ইয়েলো ডাক! প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকব স্টেজে উঠে।”
মানে হলুদ চার্টপেপার। চলবে। অরেঞ্জ লেগিংস পরা পা। কমলা ঠোঁট – কেলেংকারি করেছে! ওরকম থ্যাবড়াপানা হংসচঞ্চু বানাইব ক্যাম্নে? ঘোর দুশ্চিন্তায় জল খেতে গিয়ে ভুল করে কাফ সিরাপ খেয়ে ফেলি।
“আর ল্যাজ করে দেবে, ল্যাজ নাড়ব বেশ স্টেজে উঠে!”
এবার থপাস করে এমন জোরে বসে পড়ি যে নিজের ল্যাজে, আহ নেই, মানে থাকলে যেখানটায় থাকত সেখানে ব্যথা লেগে যায়।
নাড়ানোর যোগ্য ল্যাজ বানাতে হবে? হাঁস সাজতে গিয়ে আমায় হাঁসফাঁস করিয়ে দিচ্ছিস তো!
পরদিন সেটাও পালটে যায় আবার। তিনি স্বপ্নে জিরাফ দেখেছেন। অতএব এবার জিরাফত্বের দাবি।
এককথায় নাকচ করে দিই। অত লম্বা গলা খালি চার্ট পেপারের কম্মো নয়। আর অফিসের পর ঘুরে ঘুরে অত বড় থার্মোকল জোগাড় করে এনে তাতে জিরাফ কাটা, পড়তায় পোষাবে না। আর সেই এক সমস্যা, স্টেজে উঠে কি বা পোজ দেবে? তার চেয়ে হাতি হ!
“এলি! এলি দ্য এলিফ্যান্ট!”
ছাই রঙের চার্ট পেপার কি হয়? না হলে সাদা এনে রং করতে হবে। দুটো ধ্যাবড়া কান, শুন্ড, ও হো সাদা তো লাগবেই দাঁত করতে হবে, ওরকম ছাই ছাই রঙের লেগিংস আছে মনে হচ্ছে, ব্ল্যাক শু। একটা পুঁচকে কলাগাছ পাওয়া যায় কিনা খুঁজব চেম্বুরের বাজারে?
পরদিন আবার মন খুঁতখুঁত করে। ঠিক তেমনটা হচ্ছে না।
আচ্ছা, তোর ইশকুল কি চিড়িয়াখানা নাকি? খালি জীবজন্তু সাজতে চাইছিস কেন?
তিতির আর কিছু ভেবে না পেয়ে বোধহয় গাছ হতে চাইল এবার।
এটা কিন্তু আমাদেরও মনে ধরল। বেশ দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়াবে, সারা গায় ব্রাউন পেপার জড়িয়ে দেব। সবুজ চার্ট পেপার কেটে পাতা করে ডালে আটকে দেব, ফুল-ফলও লাগিয়ে দেব কিছু, আর ছোট পুতুল মাংকিটা ঝুলিয়ে দেব এক হাতে। মাথায় একটা ঝাঁকড়া পাতা-ফাতাওলা হেডব্যান্ড, তার মধ্যে একটা পাখির বাসা বসিয়ে দেব নাহয়, ঐ ম্যাকাও পুতুলটা আর গোটা দুই ছোট বলকে ডিম করে...
“সত্যিকারের ডিম দেবে! আন্ডা!”
“আরে! পড়ে গেলে ফেটে যাবে, সব চটচট হবে!”
“না সত্যিকারের ডিম দিতে হবে। ম্যাকাওটা বেশ তা দেবে!”
কদিন এটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলল। তারপর এক ঘনঘোর সন্ধ্যায় তিতিরের দিম্মার ব্রেনওয়েভ।
সরস্বতী পুজোয় পরবে বলে কেনা লাল-পাড় উজ্জ্বল হলুদ শাড়ি আছে।
তিতিরের মাথায় লম্বা চুল আছে।
এক কাঁড়ি হার-বালা-টিপ ইত্যাদি আছে।
ছ মাস আগে নতুন ওয়াশিং মেশিন কেনার দরুণ একটা জম্পেশ চৌকো শেপের থার্মোকল আছে।
শাড়িটি পেঁচিয়ে, চুড়োখোঁপা বেঁধে, মালা টালা পরিয়ে, আর ঐ থার্মোকলে ভারতের ম্যাপ সেঁটে দড়ি দিয়ে পিঠে বেঁধে দিলেই
“ভারতমাতা”!
যুগোপযোগী রূপ? আরে দূর, আমাদের বঙ্কিম অরবিন্দ রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা, আদি, আবহমান, চিরন্তন
সবাই মিলে এটা ফাইনাল হয়ে গেল। কাজেই আর না ভেবে কাজে লেগে গেলুম। পরদিনই ফিরতি পথে নীল, কমলা, গাঢ় সবুজ, কলাপাতা সবুজ, আর হলুদ সব রকম চার্ট পেপার নিয়ে এলুম। অত বড় ম্যাপ কোন একটা পেপারে হবে না, আর জোড়াই যখন দেব তখন একটু রং নিয়ে নিই! টুলে চড়ে, কোন অঘটন না ঘটিয়ে থার্মোকলটিও প্রত্যন্ত মাচা থেকে আহরণ করে ফেললুম।
পরের দিনটা গেল তাতে মাপসই চারটে ফুটো করতে যাতে তিতিরের পিঠে ওটা বাঁধা যায়। বেঁধে দেখে নিতে হল আন্দাজ করার জন্য, আর তার ফলে আরেকটু হলেই সব প্ল্যান ভোগে যাচ্ছিল, কারণ তিতির ওটা পিঠে বাঁধা অবস্থাতেই খেলার ঘরে যেতে গিয়ে দরজায় আটকে গেছিল। আমি পৌঁছনোর আগে আরেকটু টানাটানি করলেই দুর্বল থার্মোকল দেহরক্ষা করত। উদ্ধারপর্ব সেরে, তাতে আগাপাশতলা আকাশ নীল পেপার সেঁটেও ফেললুম। একদিনের পক্ষে যথেষ্ট!
তিতির কাউকে বলবি না কিন্তু কি সাজছিস! সারপ্রাইজ, হ্যাঁ?
অতএব, পরদিনই তিতিরের সারা ক্লাস, এবং বাড়ির সব বন্ধু জেনে গেল ‘ভারতমাতা’ কারে কয়! সবাইকেই গুছিয়ে বারণ করে হয়েছে অবশ্য কাউকে যেন না বলে, কারণ এটা ‘সারপ্রাইজ’!
---
শনিবার ফ্যান্সি ড্রেস কম্পিটিশন। বিষ্যুদবার রাত অবধি কাজ আর বিশেষ এগোল না। শুক্রবার আধবেলা ছুটি নিলুম শেষে। একটু ফাঁকিবাজির চেষ্টা করলুম, দোকান থেকে বড় সাইজের ভারতের ম্যাপ কিনে আনতে গেলুম। কিন্তু পেলুম না, নেই। যাকগে যাক, বয়েসকালে রাখীদির তত্ত্বাবধানে কয়েকশোবার ভারতের ম্যাপ এঁকেছি, এটাও এঁকে দেব। বাইরের ঘরে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসা গেল, চার্ট পেপার, ফেভিকল, কাঁচি, পেন্সিল রবার সব নিয়ে, রেফারেন্স হিসেবে ট্যাবে ভারতের ম্যাপ খুলে। কমলায় উত্তর ভারত, হলুদে পশ্চিম, কলাপাতা সবুজে পূর্ব আর গাঢ় সবুজে দক্ষিণ ভারত। উত্তরটা অনেক কসরত করে এঁকে মুখ তুলে দেখি তিতির ট্যাব নিয়ে পগারপার।
তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে পাশে বসিয়ে, ম্যাপ খুলে আবার আঁকতে বসলুম। ওরে চা দিচ্ছিস না কেন? পিঠে ব্যথা হয়ে গেল যে!
আমাদের কচিবেলায় প্যাকম্যান বলে একটা গেম ছিল মনে আছে? আজকের ভিডিও গেমস এর পূর্বজ? সেই একটা আধখানা মুখ কপ কপ করে গুল্লি খেতে খেতে যেত? গুজরাট আঁকতে গেলেই আমার সেটার কথা মনে পড়ে যায় – কেমন একটা হাঁ মুখের মত না? খুব যত্ন করে সেই হাঁয়ের খাঁজগুলো আঁকছি, মাতৃদেবীর মন্তব্য, খুব তো কারুকার্য করছ, ঐ সঘন কম্পমান রেখা বরাবর যে কাটতে হবে সে খেয়াল কি আছে?   
শুনেই তো আমি নেই! অ্যাঁ, আবার কাটতেও হবে?
সে তো হবেই! নইলে অত কষ্ট করে নীল কাগজ মারলি কেন ঢ্যাঁড়শ? সমুদ্দুর বোঝাবি বলে না?
তাই তো! তেমনই তো ভেবেছিলুম বটে। নাগাড়ে এতক্ষণ উপুড় হয়ে ম্যাপ আঁকতে গিয়ে সে তো ভুলেই মেরে দিয়েছি। আচ্ছা দেখা যাক কদ্দূর কি পারি। আগে দেখ তো চারটে অংশ সমঞ্জস হল কিনা।
তিতির দেখে বলল “কি সুন্দরী হয়েছে মাম্মা!”
মা দেখে বলল ডানদিক উঠে আর বাঁদিক নেমে গেছে।
সে তো আমার মাগো, এঁকে এঁকে ডান কাঁধ টনটন আর ভর দিয়ে বসে থেকে থেকে বাঁ কাঁধ অসাড় হয়ে গেছে!
কিন্তু ম্যাডামজী ঠিকই বলেছেন, উঠে দাঁড়িয়ে দেখি ত্যাড়াব্যাঁকা হয়ে গেছে ব্যাপারটা। এত বড় স্কেলে আগে তো আঁকিনি। আবার রবার পেন্সিল নিয়ে লেগে পড়ি।
উফফ কি খাটনি! হ্যাঁ রে, আইডিয়া! তুই ‘স্কুলগার্ল’ সেজে যা না?
দিম্মা আর নান্নির যৌথ দৃষ্টিক্ষেপে প্রায় ভস্ম হয়ে গেলুম। কিন্তু আরেক কাপ চা না দিলে মাইরি পারছি না যে! আর তোমরা বাপু নিচে খেলতে যাও, তিতির এরকম চারদিকে ধেই ধেই করে নেচে বেড়ালে আর মিনিটে মিনিটে কানের কাছে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ফেললে মন দিতে পারছি না তো!
---
রাত নটা। তিতির খেতে বসেছে। ম্যাপ আঁকা শেষ, চার টুকরো জুড়ে আটকানো হয়ে গেছে, থার্মোকলের ফুটো দিয়ে জরির ফিতে পরিয়ে রাখা আছে, স্টেজে ওঠার আগে বেঁধে দিলেই হবে। দিম্মা বিকেলে বেরিয়ে ঘুড়ির কাগজের মত পাতলা ফিনফিনে কাগজ কিনে এনেছেন, এখন সেগুলো কায়দা করে কুঁচি বানিয়ে তাই দিয়ে হাতের গলার খোঁপার মালা গাঁথছেন। আমি এখনো ভূমিতলে, এবার ভারতমাতার হাতের ঝান্ডা বানাচ্ছি। সাইজমত লাঠি খুঁজে পাইনি, একবার ভাবছি আলমারির সাইডের একটা রড খোলা যায় কিনা, একবার ভাবছি মপার এর ডান্ডাটা খুলে নিলে কি মা চেঁচাবে, একবার ভাবছি তিতিরের ভাঙ্গা ছাতার ডাঁটিটা কি চলবে, করতে করতে মনে পড়ল একগাদা ইলেকট্রিক লাইনের কভারের টুকরো পড়ে আছে, তার একটা মাপমত এনে কাগজ পেঁচিয়ে দিলেই হবে। আরো একটা টাস্ক লিস্টে জুড়ল তার মানে।
রাত সাড়ে দশটা। ম্যাপ – চেক। ফ্ল্যাগ – চেক। বেশ পাকাপোক্ত পতাকা হয়েছে – ঐ যাঃ, অশোকচক্র আঁকতে ভুলে গেছি যে! থাক, কাল সকালে হবে, এখন আঁকলে সে চক্র বড়ই বক্র হবে। কাগজের মালাসমূহ – চেক। এক্সট্রা ব্যাকাপ গয়নাগাঁটি - চেক (যা শান্ত মেয়ে, যদি কাগজ ছিঁড়ে ফ্যালে স্টেজে ওঠার আগেই?)শাড়ি – চেক। আর যা যা লাগতে পারে – চেক। চ চ শুতে চ এবার।
----
পরদিন ব্রাশ করেই আগে অশোকচক্র প্রদান করি, মানে পতাকাকে আর কি। তারপর ভারতমাতা নির্মাণ পর্ব। শাড়ি পরা সাজুগুজু সব কিন্তু সুন্দর চটপট হয়ে গেল, খালি মাঝে একবার ভারতমাতা আত্মবিস্মৃত হয়ে খাটে উঠে ধেই ধেই করে লাফাচ্ছিলেন আর শাড়ি গোঁজার সময় তাঁর খুব কাতুকুতু লাগছিল বলে তিনি গোঁসা হয়েছিলেন দু মিনিটের জন্য।
    তারপর আমরা শোভাযাত্রা করে রওনা দিই। সবার আগে ‘ভারতমাতার অঙ্গসজ্জায়’ দিম্মা, তার কাঁধের ব্যাগে ব্যাকাপ গয়নাগাঁটি আর হাতে একটা প্লাস্টিকে খুব সন্তর্পণে নেওয়া কাগজের মালাগুলো। তার পিছনে একহাতে পতাকাটি উঁচু করে ধরে আর অন্য হাতে খাবার জলের বোতল নিয়ে ‘ফ্ল্যাগ-গার্ল’ বন্দনা। তার পিছনে স্বয়ং ভারতমাতা, সুহাসিনী, সুভাষিনী – মানে খিল খিল করে হাসছে আর অনর্গল বকবক করছে। আর সবার শেষে ‘দেশের ধারক ও বাহক’ আমি, হাতে ঐ গোবদা ম্যাপ রাস্তা দিয়ে যেই যাচ্ছে চেনা হোক বা অচেনা, বেশ একগাল হেসে দিচ্ছে। দেখে মনে পড়ল, গত বছরও এই ফ্যান্সি ড্রেস হয়েছিল। তিতির সেবার সেজেছিল পাকানো গোঁফ ওলা, মাথায় পাগড়ি, পিঠে তীর ধনুক, হাতে তরোয়াল “বীরপুরুষ”। হ্যাঁ মশাই, ওর প্রিয় কবিতা যে! তো সেবার এত মালপত্তর ছিল না, আমি একাই ওর হাত ধরে যাচ্ছিলুম। পথে এক বয়স্কা মহিলা, স্থানীয় ঢঙ্গে কাপড় পরা, ওকে দেখে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ‘জয় রামজী’ বলে এক বিশাল নমস্কার!
    এবারে অবশ্য সেরকম কিছু হল না। স্কুলে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়াতে হল, বন্দনার সাথে ম্যাপ আর ফ্ল্যাগ পালটাপালটি করলুম – গোটা ভারতবর্ষের ভার আর কতক্ষণ একা বওয়া যায়, বলুন? আরো সব ছেলেমেয়েরা আসছে – ভুল বললুম। আজ ছেলেমেয়ে না। আজ আসছে মৌমাছি, প্রজাপতি, লুডোর ছক্কা, ম্যাজিশিয়ান, প্রজাপতি, রামচন্দরজী, সেলফোন, কৃষ্ণ, রকেট, আবার প্রজাপতি, আবার কৃষ্ণ, মাদার টেরিজা (কি বলেছিলুম? থাকবেই), পুলিশ, আবার আবার প্রজাপতি, নিনজা, আবার আরেকটা রকেট, এটা কি – খনিশ্রমিক বোধ হয় – ও না, কৃষক, বার্বি ডল, ঝাঁসীর রানি, জলদস্যু – বা বেশ তো, স্পঞ্জবব, গাজর, কাশ্মিরী কন্যা, বোঝো! নরেন্দ্র মোদী! প্রিন্সেস, পোস্ট বক্স, এ আবার কে? কিউপিড – অ্যাঁ, পাঁচ বছরের ছানা কিউপিড মানে বোঝে? ডাক্তার, মারাঠী ভাউ। যাহ! এ বছর একটাও হনুমান নেই? গত বছর গোটা দুই ছিল, সেই সাথে এক নগ্নদেহ পল্লবমেখলা-আবৃত আফ্রিকান ট্রাইব-বালক।
    যাই হোক এরা ভিতর যায়। আমরা সারি বেঁধে হলে গিয়ে বসি। তারপর এরা আবার লাইন করে এসে এক পাশে দাঁড়ায়। অমনি আমরা সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠে গিয়ে যার যার ছানাটাকে ফিনিশিং টাচ দিয়ে দিই। দিম্মা মালাগুলো ঠিকঠাক করে দেয়, আমি আর বন্দনা মিলে ভারতবর্ষকে যথাস্থানে বেঁধে ফেলি। তিতির অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে যায় তারপর, ম্যাপে কেউ যেন ‘টাচ না করে!’ হবি তো হ তার পিছনে দাঁড়িয়েছে কৃষক বালক - সে সমানে ‘চল কোদাল চালাই’ করছে। তিতিরের নির্বন্ধাতিশয্যে তাকে আবার একটু বাবা-বাছা করে বলে দিই সে যেন এই ভারতবর্ষের মাটিতে চাষ করতে না লেগে যায়।
    বসে বসে দেখতে কিন্তু ভারি ভাল লাগে যাই বলুন। কৃষ্ণ লাল-কালো কাবলি চপ্পল পরত, জানতেন? নরেন্দ্র মোদীর দাড়িটা বোধহয় টুথপেস্ট দিয়ে বানিয়েছে, গরমে ঘামে গলে গলে গেছে। ঝাঁসির রানি বেশ স্মার্ট তো, কি সুন্দর পিঠে পুতুল বেঁধে, তরোয়াল বাগিয়ে বেঁকে দাঁড়াল! এই যাহ, রকেটের তিনকোণা টুপি খুলে পড়ে গেছে, টিচার পরিয়ে দিতে আবারো খুলে পড়ে গেল – থাক থাক, এ রকেট ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস। রুবিক কিউব নিজেই চারপাক ঘুরে গেল স্টেজে। সব মিলিয়ে হাসির ফোয়ারা। ভারতমাতা হাসিমুখে ফ্ল্যাগ ধরে দাঁড়িয়েছেন, ভাল হাততালিও পেয়েছেন।
    শেষ হবার পর আরেকটু ইনফর্মাল ছবি তোলা টোলা হয়। তিতিরের পিঠ থেকে ম্যাপটা খুলে নিয়েছি, সে রামচন্দ্র আর নিনজার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। ঝাঁসির রানী আর মীরাবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দেখে শখ হল তিনকন্যার একটা ছবি তুলি। তা তাদের তখন খেলার মুড – তুললাম তো ছবি, তাতে দেখি ভারতমাতা আর মীরাবাই খামচাখামচি করছে আর ঝাঁসির রানী তরোয়াল বাগিয়ে কোনটাকে আগে পেটাবে তাই ভাবছে। কি অপূর্ব ছবি, ভাবছি ‘অগ্নিকন্যা’ ক্যাপশন দেব কিনা, চোখে পড়ে কে যেন এসে ম্যাপ-টা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁ হাঁ করে উঠতে গিয়ে দেখি তিতিরের ক্লাস টিচার – মাতৃদেবী সলজ্জ মুখে জানান টিচাররা নাকি বলেছেন ঐ ম্যাপ এখন থেকে স্কুলে সাজিয়ে রাখা হবে। ভ্যাবলাপানা হাসিমুখে দেখি আমার এই এত ঘন্টার পরিশ্রমের ফসল ম্যাপ, মায় ফ্ল্যাগটা অবধি দুই টিচারের হাতে অন্তর্হিত হল। কি ভাগ্যিস আলমারির কি মপারের রড খুলে ফ্ল্যাগের ডান্ডা বানাইনি!
    ---
এক বিশাল পর্ব নির্বিঘ্নে সমাপন করায় মন বেশ প্রফুল্ল ছিল। রাত্রে ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ গাইতে গাইতে ঘুমোতে যাচ্ছিলুম, কন্যার প্রশ্ন,
“জননী মানে মা তো?”
“হ্যাঁ মাভারতবর্ষ আমাদের দেশ তো, দেশকে ভালবেসে মা বলা হচ্ছে।”
“ভারতবর্ষ আমাদের মা?”
“হ্যাঁ, তাই তো বলছে।”
“আর ভারতবর্ষ আছে পৃথিবীর মধ্যে, তাই তো?”
“ঠিক।”
“তাহলে পৃথিবী হল ভারতবর্ষের মা, মানে পৃথিবী আমাদের দিম্মা
নিজের মা আর দিম্মাকে যুগপৎ হতভম্ব করিয়ে দিয়ে ছোট্ট মেয়ে শুতে চলে গেল।

Sunday 30 October 2016

বাঁদোর


তিতির না, বাঁদর ওড়াতে ভারি ভালবাসে।

আরে না না আমার মাথা খারাপ হয়নি। বোম্বেতে সত্যিই বাঁদর ওড়ানো হয়। বেলুন দিয়ে তৈরি বাঁদর। জুহু বিচে হু হু করে হাওয়া দেয় তো, ঐ বাঁদরের সঙ্গে লম্বা সুতো দেয়, ঠিক ঘুড়ি ওড়ানোর মত করে লোকে ওড়ায়।

ওগুলো বানায়ও খাসা। গোল বেলুনের মাঝে বেঁধে মাথা ও পেট, লম্বাটে বেলুন দিয়ে হাত আর পা, একটা সরু লম্বা পাকানো গোছের বেলুনের ল্যাজ। এহেন বাঁদর যে তিতিরের পছন্দ হবে সেটা বলাই বাহুল্য। তার ওপর উড়ন্ত বাঁদর। তিতিরের চেয়েও, তার দাদুমণির বেশি পছন্দ দেখি। ছোট্টবেলার ঘুড়ি লাটাই নিয়ে ছাতে ভোকাট্টা করার স্মৃতি ফিরে আসে মনে হয়। তাই সময় সুযোগ হলেই পল্টন নিয়ে জুহু যাবার চেষ্টা করি। কিন্তু ইদানীং সেটা আর হচ্ছে না, অফিসে কাজের চাপে ফেঁসে চিপিটক-মূর্তি ধারণ করিতেছি কিছুকাল ধরে, সময় বার করতেই পারছি না।

কিন্তু পুঁচকি মেয়ের কি বেড়াতে না গেলে ভাল্লাগে, না আমারই ভাল্লাগে ওকে নিয়ে যেতে না পারলে! কাজেই জুহু যখন হচ্ছে না তখন জিজাই সই! মানে রাজমাতা জিজাবাই উদ্যান, অর্থাৎ রানীবাগ, অর্থাৎ বাইকুল্লা জু - বোম্বের একমাত্তর চিড়িয়াখানা।

কলকাতার চিড়িয়াখানা গিয়ে যারা অভ্যস্ত তারা অবশ্য নাক সিঁটকোবে। বলতে গেলে কিছুই প্রায় নেই জন্তু জানোয়ার। কয়েকটা হাতি হরিণ বাঁদর (না উড়ন্ত নয়) জলহস্তী কুমীর নীলগাই নেকড়ে আর কিছুকিঞ্চিৎ পক্ষীকূল চিড়িয়াখানার নাম রোশন করার ঝিমন্ত চেষ্টা করে। এক ঘন্টার বেশি লাগে না ঘুরতে।

কিন্তু কপালগুণে আমার মেয়ে মায়ের সাথে বেই-বেই বড় ভালবাসে। সে সামান্য একটা দোলনাওলা পার্কে নিয়ে গেলেও ভারি খুশি হয়। আরেকটা সুবিধে হল ভারি কাছে, টুক করে আধ ঘন্টায় পৌঁছনো যায়। সুতরাং রোববার জলখাবার খেতে খেতেই ঠিক করলুম আপাতত রাজমাতাকেই দর্শন করে আসি।

সেজেগুজে বেরোতে যা দেরি। তিতিরের প্রশ্নাবলী শুরু হয়ে গেল।
আমারও মন ফুরফুরে, তাই উত্তর দিতে কার্পণ্য নেই।

'মা আমরা জু যাচ্ছি, না?'
'
হ্যাঁ মা। জু যাচ্ছি তো।'

'মা আর কদ্দূর?'
'
আরে এই তো শুরু করলুম। একটু সময় লাগবে দাঁড়া।'

'মা জুতে হাতিগুলোর আমাকে মনে আছে?'
'
হ্যাঁ! ওরা তো রোজ বলে তিতির কবে আসবে, এখনো আসছেনা কেন।'
(
আহ্লাদে তিতির এক গাল হেসে ফেলে।)

'মা আর কদ্দূর?'
'
আরো খানিকটা মা।'

'মা আমি কিন্তু খেলাও কব্বো, আমায় খেলা করতে দেবে তো?'
'
বেশ তো, করিস। স্লিপ দোলনা কিসব আছে তো চ দেখি।'

'কি মজা না, আমরা জু যাচ্ছি?'
'
হ্যাঁ মা।'
(
মা এবার একটু পরিশ্রান্ত)

'মা আর কদ্দূর?'
'
আর একটু সোনা।'

'কুমীর আমায় খেতে আসবে না তো?'
'
না না অমন দুষ্টুমি করলে আমি কুমীরের কান মলে দেব।'

তিতিরের গম্ভীর মুখে আপত্তি,
'
কি করে মলবে? কুমীরের মোটেই কান নেই, কানের ফুটো আছে। আমি ছবি দেখেছি।'
বিব্রত মা মেকাপ দিতে চেষ্টা করে,
'
আহ হ্যাঁ ওই কানের ফুটোয় চাঁটি মারব।'

'মা আর কদ্দূর?'
'
এইবার এসে গেছি, আর একটু রে।'

'মা আর কদ্দূর?'
'
চুপ করে বোস না আর তো একটুখানি।'

'মা আর কদ্দূর?'
শুনতে পাইনি ভাব করে জানলা দেখতে থাকি, আহা কি নীল আকাশ মৃদু সমীরণ ছ্যাঁকছ্যাঁক রোদ উড়ু উড়ু মন...
ধৈর্যর মহতী পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে চিড়িয়াখানার গেটে নামি অবশেষে। ছোট্ট মানুষের হাত ধরে গটগট করে ঢুকে পড়ি। পরক্ষণেই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিই।

লেঃ! একেই কিছু নেই, তায় আবার চারদিকে খুঁড়ে টুঁড়ে একাকার করে রেখেছে। কি বানাইতেছ হে হরিপদভাই?
হরিপদ না, জাকিরভাই। সব সারাই হচ্ছে। ঝকঝকে নতুন হবে। জনরব নাকি পেঙ্গুইনও আসবে!

বেশ বেশ। আপগ্রেড হচ্ছে দেখে পরম পুলকিত হয়ে পক্ষীঘরের দিকে হাঁটা দিই। ও তিতির, কাকাতুয়া না, ওটা ম্যাকাও। এইদিকে কাকাতুয়া দেখ। আর এদিকে পিছন দিকে ধনেশ পাখি তার ঠোঁট সামলে বসে আছে দেখেছিস? আর এই খাঁচাটায় ব্ল্যাক আইবিস আর পেইন্টেড স্টর্ক, মনে আছে দিম্মা চিনিয়ে দিয়েছিল?

পাখপাখালি দেখে আর কিছু খুঁজে পাইনা। যে খাঁচায়ই উঁকি দিই, সেটাই খালি। এমনকি এঁকেবেঁকে যাওয়া খালটাও। রেগেমেগে খেলার জায়গাটায় চলে গেলুম দুজনে। সেটা পেয়ে অবশ্য তিতিরের আহ্লাদ আর ধরে না। নেচেকুঁদে চড়ে দুলে ঘুরপাক খেয়ে হেসে লাফিয়ে তার দিলখুশ, আম্মো খুশ।

তারপর যে দুটো অবধারিত থাকে, সেই কুমীর আর হাতি দেখিয়ে নিই।
কুমীর জলে পেট ডুবিয়ে শুয়ে ঘুমঘুম করছে, আর হাতিরা তেড়েফুঁড়ে কান আর ল্যাজ নাড়ছে।
তিতিরের তাই দেখেই মহানন্দ। যাই বল বাপু, ভারি তৃপ্তি হয় ঐ হাসিটা দেখলে।

তারপর মা-মেয়ে হাত ধরাধরি করে দোলাতে দোলাতে, পপ কর্ণ কিনে, ভোঁ করে বাড়ি ফিরে আসি। এসে স্নান করার আগে তেল মাখতে মাখতে তিতিরের হঠাৎ খেয়াল হল, 'বাঁদর দেখলুম না তো!'

ভাবলুম বলি দিবারাত্রি রাস্তায় বেরোলেই দেখিস তো, এই জঙ্গল ভরা কলোনিতে তারা সদলবলে বিরাজ করে। যত পায়রা, তত কাঠবিড়ালি আর ততই লালমুখো বাঁদর।

তার আগেই, কন্যা বললেন, 'এই দ্যাকো আমি কি সুন্দর বাঁদোর হইচি!'

আমি মুগ্ধ চোখে তেলচুকচুকে গায়, দু হাঁটু অল্প ভেঙ্গে, দু হাত কুস্তিগীরের পোজে তুলে গাল ফুলিয়ে দাঁড়ানো মেয়ের খুশিমুখ দেখি। নাহ, পরের রোববার এই মিষ্টি বাঁদরটাকে বাঁদর ওড়াতে জুহু নিয়ে যেতেই হবে দেখছি!

Sunday 11 September 2016

বন্ধুমহল


কন্যা বড় হইতেছেন। আমার যেমন একটি হুল্লোড়ে আড্ডাবাজ বন্ধুর দল আছে, তিতিরেরও তেমনি একটা বেশ খেলুড়ে বন্ধুর দল জুটে গেছে এদ্দিন এ বাড়িতে থাকায়। সেই পেঁপেগাছের গল্পে বলেছিলুম না তাদের কথা? তিতিরের বিকেল মানেই তাড়াতাড়ি দুধ-টুধ খেয়ে নিয়ে, একটা ফুটবল কি ক্রিকেট ব্যাট কি ছোট্ট টেডি বগলে নিয়ে নিচে গিয়ে হাঁকডাক করে তাদের বাইরে আনা। তারপর সেই নানা বয়েসী খুদেরা দঙ্গল ব্যাডমিন্টন কোর্ট জুড়ে দাপাদাপি করে বেড়ায় অন্ধকার না হয়া অবধি।

কি যে খেলে তা বলা ভারি মুশকিল। মানে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে এরা বোধহয় ক্রিকেট ছাড়া আর সব কিছু খেলে ফেলতে পারে, গদার মত ব্যাট বাগিয়ে মারামারি, মাটি-বালির পাহাড় বানিয়ে তাতে ব্যাট পুঁতে দিয়ে পতাকা বানানো, মায় কনুই এর ওপর ব্যাট ব্যালান্স করতে করতে হাঁটার কম্পিটিশন অবধি। কিংবা ফুটবল হয়ে যায় উটপাখির ডিম। কিংবা তিতিরের টেডি আর সজলের ডাইনোসরের মধ্যে মুংলি বনাম শের খান টাইপের যুদ্ধু চলে।

আবার কোন কোন দিন, খেলার জের বাড়ি অবধি গড়ায়। মানে হয়তো বৃষ্টি এসে গেছে, কিংবা খেলে আশ মেটেনি, তিতিরের সাথে তার কোন বন্ধুও বাড়ি এসে হাজির হয় আরো খেলবে বলে। আমি অবশ্য তাতে ভারি খুশি হই, তারাও কেন জানি না আমায় আরেকটা খেলার সাথী হিসেবেই গণ্য করে। কিন্তু মাঝে মাঝে নাজেহালও কিছু কম হই না এসব দিনে। কিন্তু সেটা বলার আগে আরেকটা ভারি মজার কথা মনে পড়ে গেল এই বন্ধুর খেলতে আসা নিয়ে, সেটা আগে লিখেছি বলে তো মনে পড়ছে না – টুক করে বলে নিই?

তিতির তখন ছোট। স্কুল যাচ্ছে সদ্য। হিন্দি ভাষাটা একেবারেই বলতে পারে না, অতি সামান্য বোঝে। তার এক বন্ধু মিহির এসেছে খেলতে। সে বাংলা জানেই না, বলা বাহুল্য। সে আবার তিতিরের চেয়েও আমার সাথে খেলতে বেশি ভালবাসত, আর ভাষাসমস্যাটাও ছিল, তাই আমিও তখন ওদের সাথে খেলতুম। তা আমি একটা খেলনা কুমীর নিয়ে পা টিপে টিপে তার পিছন থেকে আসছি, উদ্দেশ্য মহৎ, চমকে দেব – তিতির ভারি শশব্যস্ত হয়ে তাকে গিয়ে বলল, ‘পিছনমে দেখো, কুমীর আয়া! তুমকো ভয় দেখাতা হ্যায়।”

ছেলেটি কিন্তু দিব্যি বুঝে গেছিল কি বলা হচ্ছে!

এইবার এখনকার গল্প। আগের হপ্তায় না তারো আগের হপ্তায় কবে যেন, বাড়ি ফিরেছি গলদ্ঘর্ম হয়ে। বস্তা বস্তা মালপত্তর নিয়ে, কি সে আর এখন মনে পড়ছে না, হবে কিছু বাজার টাজার, এসে দেখি সজল তার মনীষাদিদির সঙ্গে এসেছে তিতিরের সাথে খেলতে। আমার যেমন মায়া দেখে তিতিরকে, সজলকে তার মনীষাদিদি সামলায়। সজল বেশ একটা গুন্ডা ছেলে, মনীষা ভারি নিরীহ শান্ত মেয়ে, কাজেই সজল মনীষাদিদিকে সামলায় বললেই সঠিক হয় আসলে।   

তো সেসব মালপত্তর রেখে টেখে একটু ভাবলুম একটু বসি, জিরিয়ে নিই। আরে ভাই বয়েস হচ্ছে তো! ও মা, বেশ করে ভিতরের ঘরে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছি কি দিইনি, পিছন থেকে খিঁক খিঁক করে হাসির আওয়াজে পিলে চমকে গেল। ঘুরে তাকিয়ে দেখি, খাটের পিছনে সরু ফাঁকে সজল উবু হয়ে বসে প্রাণপণে হাসি চাপার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বুঝলুম লুকোচুরি খেলা চলছে এদের।

পিঠ ফেলার আশা পরিত্যাগ করে বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসতে গেছি, দেখি সোফা আর ডিভানের মাঝের খাঁজে মনীষা গুটিশুটি মেরে অদৃশ্য হয়ে থাকার কঠিন সাধনায় মগ্ন। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে বেচারী এমন লজ্জা পেল, আমি আর সেখানে বসা উচিত বোধ করলুম না।

বারান্দার দিকে এগোতে গিয়ে মায়ার গলা পেলুম ‘ফাইব, সিক, সেবেন...’ মানে তিনি চোর হয়েছেন এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনছেন। বিশ্রামের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলুম, কি বলব মশাই বাথরুমটা অবধি বেহাত! সেটার দরজা ‘একটুকু ফাঁক করে’ তিতির কচ্ছপের মত মুন্ডু বাড়িয়ে দেখছে আন্টি ধরতে এল কিনা।

এর পরও লোকে বলবে আমার সহনশীলতা কম?

    তবে আজ বৃষ্টি পড়ছে ঝমাঝম। তিতিরের মন ভাল নেই, নিচে খেলতে যেতে পারছে না, জল কাদায় বন্ধুরাও কেউ আসতে চাইছে না বাইরে। জানলা ধরে সোফার পিঠে উঠে বসে আছে আর আপনমনে সেই ছড়াটা বলছে, যেটা আমরাও ছোটবেলায় বলতুম ছাতের দরজায় দাঁড়িয়ে – ‘যা বৃষ্টি ধরে যা/লেবুর পাতায় করমচা’।

    দেখছি, মায়া হচ্ছে, ভাবছি নতুন কি খেলা বানানো যায়, এমন সময় তিতিরের প্রশ্ন, “মা!! লেবুর পাতা কি কাপের মত?”

একটু সময় লেগেছিল, তারপর বুঝলাম তিতির ছড়াটা বুঝেছে ‘লেবুর পাতায় গরম চা’। যুক্তিগ্রাহ্য প্রশ্ন! মানেটা ঠিক বুঝিয়ে দিতে খুব হাসল মেয়ে। তারপর আবার জানলা ধরে বসে ঠিক করে শেখা ছড়াটা বলতে লাগল।

মনটা কেমন করে উঠলো, কেন জানি না অপু দুগ্‌গাকে মনে পড়ে গেল।  আর মনে পড়ল নিজের ছোটবেলা, এইরকম জানলা ধরে পাশের মাঠের দিকে চেয়ে বসে থাকা, সেই একলা, সরল, গল্পের বই বুকে নিয়ে কাটানো দুপুরগুলো। ভালবাসার দুপুরগুলো।

তিতির, কবে বই পড়তে শিখবি রে মা! আরো কত্ত কিছু খেলা বাকি আমাদের, সব কি আর আমি শেখাতে পারব, না বন্ধুরাই পারবে! ঐ বইগুলো ডাকছে যে!

 

Saturday 20 August 2016

শিশুপালন



    রোববারের সকালবেলা, মাছটাছ এনে, তিতিরকে লেখাপড়া করিয়ে, জামাকাপড় কাচতে দিয়ে, বেশ একটা ‘অ্যাচিভমেন্ট’  মার্কা প্রশান্তি মনে নিয়ে সবে চায়ের কাপ নিয়ে বসে কাগজটি খুলেছি কি খুলিনি, সমাধি হয়ে গেল। মানে, ধুপধাপ করে ঘাড়ে পিঠে কোলে গুচ্ছের স্টাফ্‌ড টয় এসে পড়ল, আমি তাদের তলায় সেই E.T.র মত মুন্ডুটুকু বাদে বাকিটা চাপা পড়ে গেলুম
    “দিম্মা! ও দিম্মা!”
    দিম্মা এখন নেই, কলকাতা গেছেন। সুতরাং চোখ তুলে দেখি তিতির ফিকফিক করে হাসতে হাসতে আমাকেই ডাকছে।
    এবার চোখ পাকাতে হল। মেয়ে ফাজিল চূড়ামণি জানি, তাই বলে মাকে দিম্মা বলে ডাকবে!
    তিতিরের তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা, ‘আমি না, আমার বেবিটা ডাকছে তো। তুমি আমার মা না? তাহলে তুমি আমার বেবির দিম্মা হলে তো!’
    হক কথা! আর এহেন প্রোমোশনের পর আর কাগজ পড়ার মত তুচ্ছ কাজ কি করা যায়, বলুন? তাকিয়ে দেখি, বেবিটা একটা ছোট্ট পিঙ্ক টেডি বিয়ার, তাকে আবার অন্য কোন একটা পুতুলের পেন্টু পরানো হয়েছে আর একটা পিচবোর্ডের বাক্সে শোয়ানো হয়েছে। বাক্সশুদ্ধু আমার কোলে ফেলে দিয়ে বেবির মা প্রবল আহ্লাদে সারা ঘর হেলেদুলে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল।
    “তুই অমন লাফাচ্ছিস কেন? মা কখনো ওরকম কিলবিল করে দেখেছিস?”
    “আমি তো পুঁচকে! ছোট্ট আছি না এখনো? বেবির থেকে বড়, কিন্তু তোমার মত বড় তো নই!”
    অকাট্য যুক্তির সামনে পড়ে, অতীব গাম্ভীর্য সহকারে বেবির মুখাবলোকন করা ছাড়া কিছু করার থাকল না। দিম্মা যখন হয়েছি, কিঞ্চিৎ কাজ করে দেখাই, ভেবে তাকে বেশ করে কোলে তুলে দোল দিতে লাগলুম। তিতির ডিভানের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ঠিক একটা মাগুর মাছের মত, ল্যাজের অভাবে পা নাড়াচ্ছিল, আমার এহেন স্নেহময় কর্মে কেন জানি না তার খুব আপত্তি হল। তড়াক করে উঠে বসে বলল, “বেবি ঘুমিয়ে পড়বে তো। এখন ঘুমোলে খাবে কি করে?”
    উফ্‌! দোল থামিয়ে দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করব ভাবলুম। একটা গোল বাটিপানা খেলনা দেখতে পেয়ে সেটা নিয়ে বেশ জুত করে বসেছি, আর ভাবছি, সত্যিকারের বেবিটিকে খাওয়াতে কিরকম প্রাণপাত পরিশ্রম করতে হত..তিতির হঠাৎ দেখি আমার কানের পাশে ফোঁশ ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ফেলছে।
    “কি হল রে?”
    “ঐটা নিয়েছ কেন? ওটা তো বেবির চানের মগ!”
    “অ্যাঁ! এটা তো দিব্যি একটা বাটি!”
    “তো আমার ঐ সাইজের মগ নেই তো। তাই আমি ওটা চানের মগ করেছি। ওটা থেকে কেউ খায়? আর চান করেনি কিছু না, খাবে কেন এখন?”
    হাল ছেড়ে দিয়ে বললুম, “তাহলে কি করব? আমায় ডাকলে কেন?”
আমার ছোট্ট মাতৃদেবীর বোধহয় আমার মুখ দেখে মায়া হল, আমার কোল থেকে টেডিকে তুলে নিয়ে নানাবিধ কায়দায় তাকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করতে লাগল। ঠান্ডা জল হয়ে যাওয়া চা-টা এক চুমুকে শেষ করে আবার কাগজে মন দিয়েছি, বেশ মন দিয়ে পড়ছি, হঠাৎ হাঁউমাউ করে ‘উরি বাবারে উরি বাবারে’ – সেই সাথে টেডি কাগজ ভেদ করে আমার কোলে নিক্ষিপ্ত হল।
আমি তো আঁতকে উঠেছি।
    “কি হল রে?”
    “ইঁহ্‌হ্‌!!! বেবি পটি করে দিয়েছে, তুমি পোষ্কার কর।”
    আমি আপিশ গেলে, তিতিরকে আমাদের মায়ারানী আগলান। তিনি তখন রান্নাঘরে প্রবলবেগে রান্না করছিলেন। এমনিতে, তাঁকে পাঁচবার ডাকলে তিনি আধবার শুনতে পান। এখন, কি করে কে জানে, তিতিরের মুখনিঃস্রৃত ‘পটি’ শব্দটি তাঁর কর্ণগোচর হল। হওয়ামাত্র তিনি খুন্তি টুন্তি ফেলে ঊর্ধবঃশ্বাসে তেড়ে এলেন, “চলো চলো বাথরুমে চলো শিগ্‌গির!”
    বিপন্ন তিতির ও হতভম্ব আমি যতক্ষণে তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে উঠতে পারলুম, ততক্ষণে তিতির বাথরুমের দরজায় পৌঁছে গিয়ে মায়ার সাথে কুস্তি লড়ছে। আমার কথা শুনে, একটা এত ক্ষিপ্র ও এফিসিয়েন্ট এফোর্টের এরকম অপচয় দেখে মায়া ভারী ব্যাজার হয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেল।
    তারপর তিতির আর আমি সোফায় পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসে খুব হাসলুম। আমার কোলে শুয়ে, বিক্কুট খেতে খেতে টেডিও হাসল খুব। বিশ্বাস না হয়, এই দেখ তার ছবি।

 
 

Sunday 14 August 2016

পেঁপেগাছের গল্প



রাত নিঝঝুম। বাড়ির আলো নিভেছে সব।
বিষ্টি বিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু মাথার ওপর ফুল স্পীডে পাখা চলছে, কারণ মশারি খাটানো হয়েছে।
মশারি, মানে ঘরের মাঝে ঘর। তার মধ্যে মা আর পুঁচকেপানা মেয়ে। তার কিলবিল করা আর ফুরোচ্ছে না। একবার মায়ের হাঁটুর ওপর ঠ্যাং তুলে দেয়, তো পরক্ষণেই মুন্ডু দিয়ে কাঁধে গোঁত্তা মারে। নিজের হাতটা নিয়ে তার নতুন অভিনেতার মত সংশয় আছে, কোথায় রাখবে ভেবে পায় না – ফলে নাকে, বুকে, পেটে সর্বত্র থাবড়া খেতে থাকি।
সেই সঙ্গে, সরু সরু গলায় বায়না, “গঁপ্প বঁলো...”
এই অবধি রোজের গল্প। এরপর আমি কোনদিন মরুভূমির (মরুভূমির কথা বলতে গেলেই জনসন আর রনসনকে কেন মনে পড়ে কে জানে!), কোনদিন মহিষাসুরের (এইটা একটা যা-তা  আজগুবী সিরিজ হচ্ছে। বলব পরে কখনো), কোনদিন অলিম্পিক্সের (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সও জানা উচিত, বলুন?) – মানে যেদিন যা মনে আসে সেই গল্প শোনাই তাকে।
আজ একটু অন্যরকম হল।
আমি কিছু বলার আগে, তিতির নিজেই বলে উঠল, “আমার মাথায় আজ প্রচুর ব্যাটারি আছে। ইলেবেন ব্যাটারি। আজ আমি গল্প বলব।”
নিজের সৌভাগ্যে চমৎকৃত হয়ে দু্কান খাড়া করে ফেললুম তৎক্ষণাৎ।
কিসের গল্প বলব?”
“যা খুশি, বল না!”
“না। কি নিয়ে বলব বলতে হবে। এমনি এমনি বলব না।”
মাথা কি আর কাজ করছে তখন! সেই সক্কাল সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি, সারাদিন ধরে আপিশে ঘোড়াড্ডিমে তা দিয়ে, তাপ্পর এক ঘন্টা বাস জার্নি করে এসে, ড্রাইভিং লেসন নেবার নামে ট্রেনারের হৃৎকম্প করিয়ে দিয়ে, সংসারের চাট্টি জিনিস কিনে আর চাট্টি ভুলে গিয়ে, বাড়ি ফিরে তিতিরের হোমটাস্ক করিয়ে, তার সাথে নর্তনকুর্দন করে, ডিনার পর্ব সেরে বিছানায় শোবার পর টুপ করে ঘুমে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না? যাইহোক, ওই যেগুলো আনতে ভুলে গেছি সেগুলোই মাথায় ঘুরছিল তখন। বলে ফেল্লুম, “একটা পেঁপেগাছের গল্প বল দিকি!”
“পেঁ-পে-গাচ!?” সরল চোখে বিস্ময় আর উৎসাহ মায়ের বিদঘুটে বায়না শুনে। দ্যাখ না দ্যাখ গল্প শুরু।
“একটা না, পেঁপেগাছ ছিল। ব-ড়ো পেঁপেগাছ।”
“কোথায় ছিল?” ব্যাগড়া দিয়ে ফেলি।
“ছিল? ছিল হচ্ছে...বলছি...ছিল রিলির দেশে।”
“অ্যাঁ? কোথায় বললি?”
“রিলি দেশে।”
আমার ঘুমকাতর মস্তিষ্ক ধাঁধার গন্ধ পেয়ে সজাগ। এটা কি বাংলা বর্ণমালা চেনার ফল?
“তিতির... ঋ-৯ দেশে? বাংলা ঋ-৯?”
“আরে না! রিলিইই দেশে, যেখান থেকে একটা দিদুন আমায় ফোন করে!”
বুঝে নিই।
“দিল্লি?”
“হ্যাঁ। ঐ রিলি দেশে ছিল তো পেঁপেগাছটা। তো রিলি দেশে না বুঝলে ভয়ানক ঠান্ডা পড়ে। একদম বরফ পড়ে যায় পেঙ্গুইন আর সীলমাছ দের দেশের মত। তাই পেঁপেগাছটার খুব ঠান্ডা লাগে।”
“তারপর?”
“তারপর...এই সব ছোট ছোট বাচ্চা আছে না এখানে? এই আমি, মিহির, বয় সজল, গার্ল সজল, সৌম্যা – আমরা সবাই গেছি ওখানে।”
(সত্যি ই দুটো সজল আছে বাড়িতে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে)
“বেশ তো। গিয়ে কি করলে?”
“আরে ঠান্ডা তো? আমরা বাচ্চারা মোটা মোটা জ্যাকেট পরে গেছি। আর গিয়ে বলছি ‘পেঁপে খাব, পেঁপে খাব’, কিন্তু গাছটায় একটাও পেঁপে হয়নি। ঠান্ডা বলে হয়নি। তাই আমরা খুব বায়না করছি কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। তখন আকাশ থেকে একটা পরী এসে ম্যাজিক করে দিল আর এত এত মিষ্টি পেঁপে হল গাছটায় আর আমরা ইয়াম ইয়াম করে খেয়ে চলে এলুম – হয়ে গেল গপ্পো।”
রেলগাড়ির স্পীডে গল্প শেষ।
“ও তিতির, এটা না খুব ভাল গল্প হয়েছে। এটা আমি লিখে রাখব কেমন?”
“হ্যাঁ। লিখে রেখো না!”
দমাস করে একটা পা এসে পড়ল পেটের ওপর।
“আমি কিন্তু এখন আর গল্প বলতেও পারব না শুনতেও পারব না, আমার ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে।”
এবং বিনা বাক্যব্যয়ে তিনি ব্যাটারি চার্জ করতে লেগে গেলেন, মানে ঘুমিয়ে পড়লেন, আমার একটা হাত ফোনের তারের মত মাথায় ঠেকিয়ে, আঁকড়ে ধরে।