Sunday, 30 July 2017

এক সাধারণ সকাল




ইস্কুল থেকে আনতে যাবার সুযোগ সবদিন পাই না। অফিস থাকে, আর পাঁচটা সংসারের কাজ থাকে। গতকাল পেয়েছিলুম।
 
মাকে দেখে লাইন টাইন ভেঙে তিতিরপাখি যা উসেইন বোল্ট মার্কা দৌড়টা দিল না! ভীতুর ডিম মা ভয়ে শিঁটিয়ে গেল এই বুঝি টিচার বকে দেয়। কিন্তু তিনিও আবার কী জানি কেন মাকে বড় স্নেহ করেন, একগাল হেসে হাত নাড়লেন খালি।
 
"ম্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ..."

ওরে ছাড় ছাড় ছাতা পড়ে গেল জামার পাশের সেলাই পড়পড় করে খুলে গেল চশমা বেঁকে গেল....বলতে না বলতে দেখি হাতে ব্যাগ বোতল সব ধরিয়ে দিয়ে তিনি রওনা দিয়েছেন।

আরে ধ্যাৎ, ব্যাগের চেন খুলে রেখেছিস কেন, এক্ষুণি বই পড়ে যেত...পরক্ষণেই মায়ের নিজের ব্যাগের খোলা চেন দিয়ে এক অসম্ভব অ্যাঙ্গলে পেনটা লাফিয়ে উঠে পড়ে যায়...সব ষড়যন্ত্র! সঅব!

সামলে সুমলে হাঁকপাঁক করে মেয়ের পশ্চাদ্ধাবন করি, ইয়ে হাই... হ্যাল্লো মিস্টার সিনহা...কেইসি হো মিসেস পাটিল...হেঁ হেঁ (নাম ভুলে গেছি)...হাই মিহিকা, মাম্মি কিধার?

ওরে ওরে থাম থাম ওদিকে যাব না, ওরে আমায় দোকান যেতে হবে রে, ওরে ডিম পাড়তে হবে....দুত্তোর! ডিম কিনতে হবে রে!

আর ওরে! তিতির অন্যদিকের ফুটপাথ ধরে এক দৌড়ে হুইইইই ওখানে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে স্বর্গীয় হাসি হাসছে।
 
কাছে গিয়ে পৌঁছে সবে হাহাকারটা শুরু করেছিলুম, মেয়ে ডিম নিয়ে আমার হিমসিম খাওয়াটাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, আমার চারদিকে চর্কিপাক খেতে লেগে গেল। সে এমন ঘোরান ঘুরতে লাগল যে মাথা ঘুরে আমিই উলটে পড়ি আর কি!

থাম বাপু থাম। ঘুরপাক খাবি তো কালীমন্দির চ’, বারান্দায় চমৎকার ঘুরপাক খাবার জায়গা আছে। আদ্ধেক রাস্তা যখন চলেই এসেছিস...

অমনি তিতির ছুট লাগায় তিড়িং তিড়িং...বা রে, বেশ চড়ুই পাখির মত লাফিয়ে লাফিয়ে যায়  তো মেয়েটা! অবশ্য চড়ুইয়ের মত জোড়া পায়ে না, এক্কা দোক্কার মত একবার এ পা একবার ও পা...দেখি তো আমি একটু করে কেমন লাগে...

হেঁ হেঁ ... কেইসা হ্যায়... হাঁ ম্যায় ঠিক হুঁ...আরে দূর মুখপোড়া আমার পায়ে কিছু হয়নি অমন ড্যাব ড্যাব করে দেখার কিছু হয়নি!

আরে বাহ! রাস্তার ধারে এই পোস্টারটা আগে দেখিনি তো! নাদুশনুদুশ গণেশ আর জটাজূটধারী বেদব্যাস। মহাভারত রচনা চলছে। অ্যাই তিতির! এদিকে আয় দ্যাখ দ্যাখ...

শরীরটা কোমর থেকে বাঁদিকে তিয়াত্তর ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে বেঁকিয়ে কেউ কি করে ছবি দেখে কে জানে! আমি অমন কেতরে দেখতে গেলে এক্ষুণি ভারসাম্য হারিয়ে ঠক করে মাথা ঠুকে পড়ব।  

কি দেখলি, এত পাঁয়তাড়া কষে? বল দেখি কে?

“গণেশ ঠাকুর! লাড্ডু কই?”

“সারাক্ষণ লাড্ডু খাবে নাকি? দেখছিস না লিখছে? আর সামনে এ কে বল দিকি?”

নাকের ওপর চশমা ঠেলে দিয়ে নিরীক্ষণ।

“জানিস কে?”

“হুঁউউউ! গণেশের দাদুমণি।”

“দা...ঈঁক্‌!!!”

“হ্যাঁ তো। গণেশকে হোমটাস্ক করাচ্ছে দেখছ না?”

লাফিয়ে চলে যেতে যেতে শেষ বোমাটা ছেড়ে গেল,
“এত বড় মেয়ে হয়েছো, অপিশে পড়ছো, কিচ্ছুই জানো না!”

Saturday, 8 July 2017

আদালত


 চুপ! আদালতের অধিবেশন চলিতেছে।

সাধারণতঃ, গৃহে উচ্চ আদালতের অধিবেশন চলে। তাহার রাশভারী বিচারকটি অঞ্চল কটিদেশে নিবদ্ধ করিয়া, পদ-আন্দোলন করিতে করিতে সওয়াল জবাব শোনেন এবং জলদগম্ভীর কণ্ঠে রায় প্রদান করেন। উচ্চ আদালত হইলেও ইহাতে উকিল প্রজাতির প্রবেশ নিষেধ। ফরিয়াদী আসামী স্ব স্ব মহিমায় শৃঙ্গ আস্ফালন করিয়া থাকে। গৃহের অবশিষ্ট সদস্যটি অতএব একাধারে ব্যজনকারিণী, তাম্বুল-করঙ্কবাহিনী, ভাষ্যে নীরাবলেপনকারিণী...অর্থাৎ মস্তকোপরি পাখাটি চালাইয়া দেওয়া, বিচারকের নিমিত্ত চা প্রস্তুত করিয়া আনা, কাহিনীতে কিঞ্চিৎ জল মিশাইয়া লঘুতর করিবার প্রয়াস করা, এইসব করিয়া থাকেন।

আসামীর পরিচয় আশা করি বলিতে হইবে না। 'ন্যাড়া'তুল্য এই চিরন্তন সরলহৃদয়াটিকে আসামী সাজাইয়া উপস্থিত করিবার নিয়ত ষড়যন্ত্র হইয়া থাকে। অসংখ্য বার তাহার সাতদিনের জেল তিনদিনের ফাঁসিও ধার্য হইয়াছে, কারণ ফরিয়াদীটি ক্ষুদ্র, চীৎকারপটু   গ্লিসারিন ব্যতীতই মুহূর্তমধ্যে অশ্রুপ্লাবিত হইতে সক্ষম।

কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্নতর।

আজ স্বয়ং সেই উচ্চ আদালতের বিচারক মহাশয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসিয়াছে।

অতএব আদালতে ছন্দপতন, আসামী সাজিতে অভ্যস্ত বীরাঙ্গনা আজ বিচারকের উচ্চাসনে। তিনি পূর্বাপর কিছুই জ্ঞাত নহেন, নিরিবিলি গৃহকোণে বসিয়া অতীব মনোযোগ সহকারে একটি ভৌতিক কাহিনী রচনা করিতেছিলেন, সহসা গুরু দায়িত্ব অর্পিত হইবার ফলে নিতান্ত বিচলিত বোধ করিতেছেন।

তাহার সম্মুখে ফরিয়াদী, আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনি যথাপূর্বং তথা পরং, এক পদ সোফাপৃষ্ঠে অপর পদ সোফাসীনা বিচারকের উদরপার্শ্বে রক্ষিত করিয়া প্রবল উত্তেজনা প্রবলতর হস্তক্ষেপণ সহযোগে বক্তব্য পেশ করিতেছেন। অতিরিক্ত উত্তেজনাহেতু শব্দগুলি অতিদ্রুত উচ্চারিত হওয়ায় প্রতিটি বাক্যে শব্দ হইতে "ইঁ ইঁ ইঁ" ধরণের নাসিকানির্ঘোষের যৎপরোনাস্তি আধিক্য ঘটিবার ফলে বিচারকের কিছুমাত্র বোধগম্য হইতেছে না।

প্রাক্তন উচ্চ বিচারাধিপতি, অকস্মাৎ আসামীত্ব লাভ করিয়া ইহাদের সম্মুখে বিব্রত আননে কর্ণ কন্ডূয়ন করিতে করিতে দন্ডায়মান। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া চতুর্থ জন পাকশালে আত্মগোপন করিয়াছে, না ডাকিলে তাঁহার শিখা-স্থানাধিকারী বর্তুলাকার কবরীভারের দর্শনও পাওয়া যাইবে না।

বিচারক দুই চঞ্চল পদযুগলের নৈকট্যহেতু স্বীয় দৃষ্টিসহায়ক, নাসিকা সংবেদনশীল উদরপ্রদেশ বাঁচাইতে বাঁচাইতে বারংবার প্রচেষ্টায় কন্যার ক্রোধ কিয়ৎ পরিমাণ প্রশমিত করিতে সক্ষম হইলেন। ইহার পর কথোপকথন নিম্নরূপ -

আসামী : তিতির, হোমটাস্ক শেষ করে নিই চলো।

ফরিয়াদী: ইঁ ইঁ ইঁ...দ্যাঁকো না মাম্মা...ইঁইই!

বিচারক : কি হচ্ছে কেউ একটু আমায় বুঝিয়ে বলবে!

ফরিয়াদী : দ্যাঁকো না দিম্মাঁ কি করেছে!

বিচারক : আহা কি করেছে সেটাই তো জানতে চাইছি!

আসামী : আরে সেটা তো আমিও জানতে চাইছি! কি যে হোলো হঠাৎ করে!

ফরিয়াদী : (সপ্তম সুরে) দিম্মা বলেছে! জানো! একটা ছোট মেয়ে আমি, তাকে দিম্মা বলেছে!

আসামী : কি বলেছি আবার! পড়তে বসে রবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলছিলি, তাতে 'ছেলেখেলা করছিস কেন' বলে বকেছি, তাই?

( নেপথ্যে অন্তরালবর্তিনীর হাস্যদমনের প্রয়াস শ্রুত হয়।)

বিচারক : বকেছে বলে নালিশ করছিস, তিতির? তা হোমটাস্ক ফেলে অমন করলে তো বকতেই হবে।

ফরিয়াদী : (ঢক ঢক করে মাথা নেড়ে) না!! তার জন্য নয়! বল্লুম না দিম্মা এমনি বলেছে!

আসামী : (প্রবল বিস্ময়ে) আর তো কিছু বলিনি!

বিচারক : ( ততোধিক বিস্ময়ে) আরে কি বলেছে সেটাই তো বলছিস না! কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।

ফরিয়াদী : বল্লুম তো! ছোট মেয়ে একটা, তাকে কিনা এমন বলেছে! ইঁ ইঁ ইঁ!

বিচারক  : (যানে ভি দো ইয়ারোর ধৃতরাষ্ট্রের মত) এসব কি হচ্ছেটা কি! কিচ্ছু বুঝছি না!

পুনর্বার ফরিয়াদীর বাক্যে শব্দাপেক্ষা অনুনাসিক অব্যয়ের আধিক্য। পুনর্বার বিচারক আসামী কর্তৃক তাহাকে সান্ত্বনা প্রদান, ক্ষোভের নিমিত্ত অনুসন্ধান পুনর্বার অপারগ হইয়া পূর্বাপেক্ষা অধিকতর হতভম্বত্ব লাভ।

এইরূপ চক্রাকারে অভিনয় যখন তৃতীয়বার হইতেছে, তখন বিচারকের মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ-আলোকের ন্যায় সত্য উন্মোচিত হইল। তিনি আসামীকে দ্রুত-হ্রস্ব কণ্ঠে তাঁহার কর্তব্য বুঝাইয়া দিলেন।
অতঃপর, আসামী তাঁহার ভ্রম সংশোধন করিয়া যথানির্দেশিত ভর্ৎসনা-বাক্য প্রয়োগ করিলেন। পরম পরিতুষ্ট হইয়া, ক্রীড়া স্থগিত রাখিয়া তিতিরপক্ষী অঙ্কে মনোনিবেশ করিল।

-------

সত্যি তো, এইটুকু একটা ছোট মেয়ে খেলছে, তাকে কিনা 'ছেলেখেলা' বলা - একটা আক্কেল নেই! তিতির কি বয়? 'মেয়েখেলা' বলতে হয়, জানো না?