সাধারণতঃ, এ গৃহে উচ্চ আদালতের অধিবেশন চলে। তাহার রাশভারী বিচারকটি অঞ্চল কটিদেশে নিবদ্ধ করিয়া, পদ-আন্দোলন করিতে করিতে সওয়াল জবাব শোনেন এবং জলদগম্ভীর কণ্ঠে রায় প্রদান করেন। উচ্চ আদালত হইলেও ইহাতে উকিল প্রজাতির প্রবেশ নিষেধ। ফরিয়াদী ও আসামী স্ব স্ব মহিমায় শৃঙ্গ আস্ফালন করিয়া থাকে। গৃহের অবশিষ্ট সদস্যটি অতএব একাধারে ব্যজনকারিণী, তাম্বুল-করঙ্কবাহিনী, ভাষ্যে নীরাবলেপনকারিণী...অর্থাৎ মস্তকোপরি পাখাটি চালাইয়া দেওয়া, বিচারকের নিমিত্ত চা প্রস্তুত করিয়া আনা, কাহিনীতে কিঞ্চিৎ জল মিশাইয়া লঘুতর করিবার প্রয়াস করা, এইসব করিয়া থাকেন।
আসামীর পরিচয় আশা করি বলিতে হইবে না। 'ন্যাড়া'তুল্য এই চিরন্তন সরলহৃদয়াটিকে আসামী সাজাইয়া উপস্থিত করিবার নিয়ত ষড়যন্ত্র হইয়া থাকে। অসংখ্য বার তাহার সাতদিনের জেল ও তিনদিনের ফাঁসিও ধার্য হইয়াছে, কারণ ফরিয়াদীটি ক্ষুদ্র, চীৎকারপটু ও গ্লিসারিন ব্যতীতই মুহূর্তমধ্যে অশ্রুপ্লাবিত হইতে সক্ষম।
কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্নতর।
আজ স্বয়ং সেই উচ্চ আদালতের বিচারক মহাশয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসিয়াছে।
অতএব আদালতে ছন্দপতন, আসামী সাজিতে অভ্যস্ত বীরাঙ্গনা আজ বিচারকের উচ্চাসনে। তিনি পূর্বাপর কিছুই জ্ঞাত নহেন, নিরিবিলি গৃহকোণে বসিয়া অতীব মনোযোগ সহকারে একটি ভৌতিক কাহিনী রচনা করিতেছিলেন, সহসা এ গুরু দায়িত্ব অর্পিত হইবার ফলে নিতান্ত বিচলিত বোধ করিতেছেন।
তাহার সম্মুখে ফরিয়াদী, আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনি যথাপূর্বং তথা পরং, এক পদ সোফাপৃষ্ঠে অপর পদ সোফাসীনা বিচারকের উদরপার্শ্বে রক্ষিত করিয়া প্রবল উত্তেজনা ও প্রবলতর হস্তক্ষেপণ সহযোগে বক্তব্য পেশ করিতেছেন। অতিরিক্ত উত্তেজনাহেতু শব্দগুলি অতিদ্রুত উচ্চারিত হওয়ায় ও প্রতিটি বাক্যে শব্দ হইতে "ইঁ
ইঁ ইঁ" ধরণের নাসিকানির্ঘোষের
যৎপরোনাস্তি আধিক্য ঘটিবার ফলে বিচারকের কিছুমাত্র বোধগম্য হইতেছে না।
প্রাক্তন উচ্চ বিচারাধিপতি, অকস্মাৎ আসামীত্ব লাভ করিয়া ইহাদের সম্মুখে বিব্রত আননে কর্ণ কন্ডূয়ন করিতে করিতে দন্ডায়মান। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া চতুর্থ জন পাকশালে আত্মগোপন করিয়াছে, না ডাকিলে তাঁহার শিখা-স্থানাধিকারী বর্তুলাকার কবরীভারের দর্শনও পাওয়া যাইবে না।
বিচারক দুই চঞ্চল পদযুগলের নৈকট্যহেতু স্বীয় দৃষ্টিসহায়ক, নাসিকা ও সংবেদনশীল উদরপ্রদেশ বাঁচাইতে বাঁচাইতে বারংবার প্রচেষ্টায় কন্যার ক্রোধ কিয়ৎ পরিমাণ প্রশমিত করিতে সক্ষম হইলেন। ইহার পর কথোপকথন নিম্নরূপ -
আসামী : ও তিতির, হোমটাস্ক শেষ করে নিই চলো।
ফরিয়াদী: ইঁ ইঁ ইঁ...দ্যাঁকো না মাম্মা...ইঁইই!
বিচারক : কি হচ্ছে কেউ একটু আমায় বুঝিয়ে বলবে!
ফরিয়াদী : দ্যাঁকো না দিম্মাঁ কি করেছে!
বিচারক : আহা কি করেছে সেটাই তো জানতে চাইছি!
আসামী : আরে সেটা তো আমিও জানতে চাইছি! কি যে হোলো হঠাৎ করে!
ফরিয়াদী : (সপ্তম সুরে) দিম্মা বলেছে! জানো! একটা ছোট মেয়ে আমি, তাকে দিম্মা বলেছে!
আসামী : কি বলেছি আবার! পড়তে বসে রবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলছিলি, তাতে 'ছেলেখেলা করছিস কেন' বলে বকেছি, তাই?
( নেপথ্যে অন্তরালবর্তিনীর
হাস্যদমনের প্রয়াস শ্রুত হয়।)
বিচারক : বকেছে বলে নালিশ করছিস, তিতির? তা হোমটাস্ক ফেলে অমন করলে তো বকতেই হবে।
ফরিয়াদী : (ঢক ঢক করে মাথা নেড়ে) না!! তার জন্য নয়! বল্লুম না দিম্মা এমনি বলেছে!
আসামী : (প্রবল বিস্ময়ে) আর তো কিছু বলিনি!
বিচারক : ( ততোধিক বিস্ময়ে) আরে কি বলেছে সেটাই তো বলছিস না! কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
ফরিয়াদী : বল্লুম তো! ছোট মেয়ে একটা, তাকে কিনা এমন বলেছে! ইঁ ইঁ ইঁ!
বিচারক : (যানে ভি দো ইয়ারোর
ধৃতরাষ্ট্রের মত) এসব কি হচ্ছেটা কি! কিচ্ছু বুঝছি না!
পুনর্বার ফরিয়াদীর বাক্যে শব্দাপেক্ষা অনুনাসিক অব্যয়ের আধিক্য। পুনর্বার বিচারক ও আসামী কর্তৃক তাহাকে সান্ত্বনা প্রদান, ক্ষোভের নিমিত্ত অনুসন্ধান ও পুনর্বার অপারগ হইয়া পূর্বাপেক্ষা অধিকতর হতভম্বত্ব লাভ।
এইরূপ চক্রাকারে অভিনয় যখন তৃতীয়বার হইতেছে, তখন বিচারকের মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ-আলোকের ন্যায় সত্য উন্মোচিত হইল। তিনি আসামীকে দ্রুত-হ্রস্ব কণ্ঠে তাঁহার কর্তব্য বুঝাইয়া দিলেন।
অতঃপর, আসামী তাঁহার ভ্রম সংশোধন করিয়া যথানির্দেশিত ভর্ৎসনা-বাক্য প্রয়োগ করিলেন। পরম পরিতুষ্ট হইয়া, ক্রীড়া স্থগিত রাখিয়া তিতিরপক্ষী অঙ্কে মনোনিবেশ করিল।
-------
সত্যি তো, এইটুকু একটা ছোট মেয়ে খেলছে, তাকে কিনা 'ছেলেখেলা' বলা - একটা আক্কেল নেই! তিতির কি বয়? 'মেয়েখেলা' বলতে হয়, জানো না?
এরপর থেকে মেয়েবেলা,মেয়েখেলা এসব বলতে হবে। মেয়েমানুষি আবদার....কি আর করা...
ReplyDeleteএরপর থেকে মেয়েবেলা,মেয়েখেলা এসব বলতে হবে। মেয়েমানুষি আবদার....কি আর করা...
ReplyDelete