দুপুরবেলা। খেয়েদেয়ে লম্বা হয়েছি। আজ কিনা আলুপোস্ত হয়েছিল, সেটা আবার তিতির খুব
ভালবেসে চেয়ে চেয়ে খেয়েছে বলে আমি এবং তার আন্টি দুজনেরই দিল খুশ। তায় আবার খেতে খেতে
তুতু-ভুতু পড়েছে, বগা পুলিশের কাণ্ড দেখে হি হি করে হেসেছে। ফলে দাদুমণিও দিব্য খুশ।
সদ্য গতকালই সাইকেলটা সার্ভিসিং করিয়ে এনেছি তাঁর। কাজেই ছোট্ট হৃদয় ঐ সিঁড়ির নিচের
পিঙ্ক দ্বিচক্রযানে বাঁধা পড়ে আছে, আকুলিবিকুলি চলছে সাইকেল চালাতে যাবার। ইদিকে রাস্তায়্
একে রোদ ঝাঁ ঝাঁ, তায় দেখতে পাচ্ছি বাম্পারগুলোয় সাদা হলুদ ডোরা কাটা রঙ করার কাজ চলছে,
দুজন উবু হয়ে বসে তুলি বোলাচ্ছেন। ভুলিয়ে ভালিয়ে রোদটা না পড়া অবধি কন্যাকে সাইকেল
থেকে দূরে রাখতে হবে।
এমন ঝাঁ ঝাঁ রোদ ভরে থাকত সিঁথির দোতলার ছাতটাতেও। সেটা তখনো এমন গাছের টবে ভরাভর্তি
হয়ে যায়নি। ফাঁকা জায়গায়, বোঁ বোঁ করে সাইকেল নিয়ে পাক খেত এইরকম ছ-সাত বছরের মেয়েটা।
ঝাঁকড়া ঝুমরো চুল মুখেচোখে এসে পড়ত বলে মাঝে মাঝেই মাথা ঝাঁকিয়ে সরিয়ে নিত। উঁহু, তার
এমন দেখনদার সাইকেল ছিল না। একটা তিনচাকা ছিল, কার বলো তো? তার দিদার ছোটবেলার। এক
বাক্স পিতলের কুচি কুচি রান্নাবাটি আর আদ্যিকালের হারমোনিয়ামটার সঙ্গে সঙ্গে এই সাইকেলটাও
সে উত্তরাধিকারে পেয়েছিল দিদা-বড়দিদার সেই কোনকালের ঢালা বিছানা, রঙীন কাচের জানলা
আর রোজের লুচি-পরোটার জলখাবারের শিশুকাল থেকে।
এদ্দিন অটুট রইল কী করে? কী যে বলেন না! আগাগোড়া লোহার তৈরী তো, এখনকার প্লাস্টিকের
ফঙ্গবেনে জিনিস নাকি! লোহার রড, বসার সীটের বেস, চাকা। দাদু যখন মাচার সম্পত্তি থেকে
সেটা টেনে বার করে আনল, তখন কিঞ্চিৎ জীর্ণ মরচে ধরা দশা, সীট আর টায়ার গায়েব। ঘষেমেজে,
তার উপর কটকটে আকাশী নীল রঙ করে, সীট টায়ার লাগিয়ে সেটা ছাতে তুলে দিয়েছিল দাদু। মা
কলেজ যায়, মেয়ে বাঁই বাঁই করে নীল সাইকেলে চক্কর কাটে। তিনচাকা নিয়ে ব্যালেন্সের খেল
খুব একটা সম্ভব হত না, কিন্তু স্পীডের যে কী নেশা! আর চাকায় নিয়মিত তেল দিতে ভুলে গেলেই
ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজ। ঐ আওয়াজের জ্বালায় এরকম দুপুরে সাইকেল চালানোটা হত না মেয়ের, চুপি
চুপি ছাতে গিয়ে শুরু করলেই হয় দাদু ঘুম ভেঙে ধমক দিত, নয় দিদা এসে ধরে নিয়ে যেত।
তা, আমায় ভুলিয়ে রাখা বড় সোজা ছিল। একটা
আগে না পড়া আনকোরা বই হাতে ধরিয়ে দিলেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অখণ্ড শান্তি। গল্পের বইয়ের
অভাব হলে বাংলা ব্যকরণ বা মধুসূদন রচনাবলীও চলত।
কিন্তু আমার বুকে শেল হেনে তিতির এখনো গল্পের বইয়ে ‘নিজে নিজে’ বুঁদ হয়ে যেতে পারে
না। তাকে গল্প শোনাতে হয়। কাজেই তাকে ভুলিয়ে রাখার অনেক ফন্দিফিকির করতে হয় এখনো।
“তিতির আয় আমরা অক্ষর দিয়ে ফুল-ফল-পাখি-জন্তু খেলি।”
“ইয়েয়েয়েয়েয়েয়ে!”
তিনটি ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ঝম্পপ্রদান খাটের ওপর। শেষেরটা প্রায় আমার পেটের
মধ্যে।
নাগালে পেতেই, জাপটে সাপটে শুইয়ে ফেলি, “বল দেখি পি দিয়ে।”
“পি...পাইনাপল!”
“ফল হ’ল, এবার ফুল বল?”
“প্পপ্পপ্পপ্যারট্”
“আচ্ছা বার্ড হ’ল। ফুল?”
“পি ইউ এম এ পুমা!”
“আচ্ছা, অ্যানিম্যালও হ’ল। কিন্তু ফুলটা বল?”
“বুঝলে মা, প্যারট না, পেঙ্গুইন। আমি পেঙ্গুইন বেশি ভালবাসি।“
“ফুল মনে পড়ছে না, তাই তো?”
কিলিরবিলির করে মাথা দিয়ে গুঁতো আর ভুবনমোহিনী হাসি।
“কেন কত তো আছে, প্যানজি, পপি, দিম্মার বাগানে দেখেছিলি না?”
“হুঁউউউ...মাম্মা আমি না ফুল বলব না। কালার বলব হুঁ? পি দিয়ে পাপ্পল্!”
ফাঁকিবাজ কি সাধে বলি। যাই হোক আর দুবার এমন খেলার পর বিচ্ছুটা আমায় ‘কিউ’ দিয়ে
বলতে দিল। তখন বাধ্য হয়ে অন্য খেলা আমদানি করতে হল। একটা মিনি কালারিং বুক পড়্রে
ছিল, তাই হাতে ধরিয়ে বললুম, র্যাণ্ডম একটা পাতা খুলে যা ছবি পাবি সেটা আমায় শুধু
বর্ণনা দিয়ে বোঝা, কিসের ছবি বলবি না আমি গেস করব। একদম নতুন গেম, সদ্য বানিয়েছি,
তাই প্রবল উৎসাহে খেলতে লেগে গেল। এত বকবকানির মধ্যে ঘুমোনোর চেষ্টা বৃথা বুঝে দাদুমণি উঠে বসেছিল ততক্ষণে, তিনিও যোগদানের ইচ্ছা
প্রকাশ করলেন।
“একজনের নাকে না...(ফিসফিস করে দাদুমণিকে, এটাকে কী বলে গো? ফিসফিস ফিসফিস)...নাকে
না...খড়গো আছে।”
“গণ্ডার! এত সহজ হিন্ট দিস না, শক্ত শক্ত দে।“
“উম্মম...আচ্ছা, একজনের শুঁড় আছে।“
“হাতি! বলছি না শক্ত দে?”
“হয়নি, হয়নি, ফেল!” মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে সহর্ষ কন্যা।
অ্যাঁ! হাতি নয় শুঁড় আছে? সে আবার কী? ও, বুঝেছি, শুঁড়ের অবস্থানে ভুল করেছি।
মৌমাছি? তাও নয়? তাহলে প্রজাপতি?
“আরে ধ্যাৎ! মাথায় নয়! এমনিই শুঁড় আছে।“
এবার রাম ট্যান খাই। এমনি এমনি কার আবার শুঁড় হয়?
“ছোট্ট শুঁড়। পুঁচকি পানা।“
শুঁড়ের সন্ধানে অ্যানিম্যাল কিংডম হাতড়াই। কে রে ভাই! ওদিকে ফিসফিস চলছে,
দাদুরও নাকি নামটা মনে পড়ছে না। ওঃ! পেয়েছি, ‘সূর্যদেবের বন্দী’র ক্যাপ্টেন
হ্যাডক-কে মানসচক্ষে দেখতে পেয়েছি!
“ওটাকে পিপীলিকাভুক বলে বুঝলি। পিপীলিকা মানে পিঁপড়ে, আর ভুক মানে যে খায়। ওটা
পিঁপড়ে খায়। শিখিয়েছিলুম তোকে আগে, ভুলে গেছিস।“
“আচ্ছা এইটে বলো। একজনের পিছন দিয়ে ধোঁয়া বার হয়।“
হাঁ হয়ে যাই। ওদিকে দাদু উঁকি মেরে ছবিটা দেখে বেদম হাসতে লেগে গেছে।
অনেক কসরৎ করেও এ অসম্ভব জিনিস পারি না। শেষে তিতির বই দেখায়, দেখি...
একটা ট্রাক।
“এ আবার কী! একজন বললি কেন? এক’জন’?”
“আহা, ট্রাকও তো একজন লোক। আমি চোখ মুখ এঁকে দিইনি তাই বুঝছ না।“
বুঝতেই পারছেন এমন গোলমেলে মেয়ের সঙ্গে আমি আর খেলতে রাজি হইনি। তাছাড়া সে রঙ
পেন্সিল এনে ট্রাকের চোখ মুখ আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তারপর।
একটু আবার চোখটা লেগে এসেছে, মাথার কাছে তারস্বরে চীৎকার -
“হ্যালো লোক!!! রঙ কি শুকিয়েছে এবার?”
চেয়ে দেখি তিনি জানলার সামনে বাবু হয়ে বসে রাস্তায় রং করা দুজনের উদ্দেশ্যে
হাঁকডাক জুড়েছেন। ধড়মড় করে উঠে বসতে বসতে স্বগতোক্তি শুনি -
“ও না না, দুজন লোক তো, একের বেশি। তাহলে…”
আবার পাড়া কাঁপানো চীৎকার, “হ্যালো লোকস্!”
সব্বোনাশ করেছে। নাঃ, আর বিশ্রামের আশা করে লাভ নেই, রোদটাও আর রাস্তায় নেই, যাই
সাইকেলের পিছনে দৌড়ই গে’!
❤️
ReplyDelete