Wednesday, 15 August 2018

ইকড়িমিকড়ি

ব্যাপার হল তিতির তো বড় হচ্ছে, হোমটাস্ক, গান প্র্যাকটিস, আরো নানাবিধ অ্যাকটিভিটি, জন্মদিনের নেমন্তন্ন স্কুলের পিকনিক ইত্যাদি সামাজিকতা এরকম কত কিছু ঢুকে যাচ্ছে রোজের রুটিনে আগের চেয়ে আরো বেশি বেশি সময় নিয়ে মা-মেয়ের হাপুটি-জুপুটি খেলার সময় যাচ্ছে কমে, ফলে এখন আর সব সময় তেমন গল্প গজায় না
তবু, ফাঁকফোকরে সেই যেটুকু সময় বেরোয়, তাতে যেমন মঈশাসুরের গপ্পো গজায়, তেমনি এগুলোও গজায় টুক টুক করে তাই ভাবলুম এগুলোর কথাও লিখেই রাখি, পড়ে হয়তো আর কোনো পুঁচকেপানা আর তার কোনোগাজ্জেনএসবখেলার মজাটা পাবে
ইকড়িমিকড়ি
===========
মাম্মার সঙ্গে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ঢুকল কন্যা, জামা ছাড়াতে গিয়ে দেখা গেল তার হাতের মুঠোয় একমুঠো গম মাম্মা যখন মুদির দোকানে হিসেব করে দাম দিচ্ছে, সামনের ড্রাম থেকে তুলে এনেছে
কী করবি রে?
খাব
কাঁচা গম খাবি! তুই কি পায়রা?
এঁ, না, পায়রা নোন্না করে
তবে কী করবি?
আচ্ছা, এইখানে পুঁতে দিলে হয় না? গম গাছ গজাবে বেশ, তারপর আমরা সেটা পিষে আট্টা বানাবো
আন্টি হাউমাউ করে ছুটে না এলে দিম্মার সদ্য লাগানো সং অফ ইন্ডিয়ার দফা রফা হয়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলে
তিতিরের দেখি মুখে মেঘ অগত্যা দিম্মা ভোলাতে বসল, ঐ দশদানা গমের গাছ দিয়ে আট্টা বানালে তো আমরা কেউই কিছু খেতে পারব না, তাঁর চেয়ে অন্য একটা জিনিস শেখাই তোকে চল একটা পিজবোর্ড জোগাড় করে কিছু একটা আঁক দিকি!
আঁকার নামে তো তিতির এক পায়ে খাড়া পিজবোর্ড খোঁজা নিয়ে খানিক এটা ওটা টানাটানির পর দাদুমণি একটা টুকরো জোগাড় করে দেন মাম্মা ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে কী শেখাতে চলেছেন দিম্মা, আহা, দিম্মারই তো মেয়ে তিনি, যতই না কেনঢ্যাঁড়শপ্রকৃতির হোন! মহা উৎসাহে রান্নাঘর তল্লাশি করে মুসুর ডাল, চিঁড়ে আর পেঁয়াজের খোসা সংগ্রহ করা হয়ে গেছে তার
আর কী? একটা ফেভিকলের শিশি, পেন্সিল দিয়ে একখানা আউটলাইন ড্র করা, কাঁচি দিয়ে পেঁয়াজের খোসা তিনকোনা করে কাটা আর মা-মেয়ে মিলে দিম্মার তদারকিতে পটাপট লাগিয়ে ফেলা অমনি কাগজের উপর ঝলমল করে পাখনা নাড়তে লাগল নিমোর কোনো এক ভাই-বেরাদর
এই যে তিনি!















ইকড়িমিকড়ি
============
তিতির সেদিন সবেতেইবোরহয়ে যাচ্ছে বই পড়বে না, গান শুনবে না, ছবি আঁকবে না, বিল্ডিং ব্লক নিয়ে খেলবে না, ক্রাফট বানাবে না, মেকানো দিয়ে ব্রীজ বা সাইকেল করবে নানোঁতুন কিঁচুচাই তার, মানে সেই চ্চাঁই চ্চাঁই চ্চাঁই!
তখন মায়ের মাথায় ঝিং ঝিং করে আইডিয়া এল, কবে কোনো এক সিপিয়া রঙের ছোটবেলায় এটা খেলত সে তার দিদার সঙ্গে, প্রতি পনেরো দিনে গোগ্রাসে গেলা আনন্দমেলা পত্রিকা থেকে শেখা সম্ভবত
দে তো রে তোর ছবি আঁকার খাতাটা
ন্নাঁ!!! ছবি আঁকতেবোরহচ্ছে!
আরে এটা নতুন খেলা দে নাময়ূরিকাকে
হাসবেন না বাপু আমাদের বাড়িতে একটু মজার নাম দেওয়া হয় বরাবর তিতিরের পুতুলভ্যাবাচ্যাকা খাসনবিশএর কথা তো আপনারা জানেনই, তারপর ধরুন আমাদের কলকাতার বাড়ির পাম্পের নামপাম্পুমোহন পুরকায়স্থ’, বাজারের থলিদের নাম ভাণ্ডারীআরমৎস্যগন্ধা তেমনি তিতিরের লেটেস্ট খাতাটার ওপর একটা ল্যাজঝোলা ময়ূরের ছবি আছে, তাই তার নামময়ূরিকাবলা বাহুল্য এসব দাদুমণির অবদান
খাতা এনে দিতে কয়েকটা আয়তাকার কাগজ কেটে বার করি একেকটার সাইজ ঐ এ-ফোর পাতার আদ্ধেক ধরুন তার একটা নিয়ে তিন ভাঁজে ভাঁজ করি তারপর খেলাটা বুঝিয়ে দিই
প্রথম ভাঁজে তিতির একটা মুন্ডু আঁকবে যে কোনো জীবের পশু, পাখি, মানুষ, বয় গার্ল যা প্রাণ চায়
শুধু আমাদের দেখতে দেবে না কী আঁকল মুণ্ডুর নিচ থেকে গলার দাগটা লম্বা করে পৌঁছে দেবে পরের সাদা অংশে, দিয়ে আবার এমন ভাঁজ করবে যাতে মুণ্ডু দেখা না যায়, খালি গলার দাগটুকু দেখা যায়
পরের জন, ধরুন আমি, দ্বিতীয় অংশে সেই গলার দাগ থেকে একটা শরীর আঁকব আবার সেই পশু, পাখি, মানুষ, বয় গার্ল যা প্রাণ চায়আবারও, আর কাউকে দেখতে দেব না কী আঁকলাম
কী বললেন, মুণ্ডু কার না জেনেই আঁকতে হবে? হ্যাঁ তো! সেটাই তো মজা
তারপর আমি শরীরের নিচ থেকে পায়ের দাগ শুরু করে আবার পরের, মানে শেষ সাদা জায়গাটায় বাড়িয়ে দেব দিয়ে আমার পার্টটাও ভাঁজ করে পরের জনকে দেব ধরুন এই যেমন দিম্মাকে দিলুম
সে মাথা গা কিচ্ছু না জেনে, আবার তার ইচ্ছে মত পা আঁকবে ঐ দাগ ধরে যা প্রাণ চায়
তারপর ভাঁজ খুলে পুরোটা দেখুন - হাসিমুখ মেয়ের ঝুঁটি বাঁধা মুখ, তার নিচে হয়তো চিতাবাঘের চাকা চাকা গা থাবা ল্যাজ, আর গরু বা হরিণ বা ছাগলের ঠ্যাঙ - আর হেসে লুটিয়ে পড়ুন সবাই মিলে
হেব্বি না? এইটে এখন তিতিরের হট ফেভারিট, চলছে মাঝে মধ্যেই কয়েকটা নমুনা নিচে দেওয়া গেল








Thursday, 9 August 2018

মঈশাসুর-২

শোয়ামাত্র উঠে পড়তে হয়, সেই হাওয়া ভরা নাকে ঘুঁষি মারা পুতুলগুলোর মত। একটি সৌম্যদর্শন হলুদ খরগোশ হাতে গাজর নিয়ে শুয়ে আছেন আমার বালিশে। খরগোশ সরিয়ে, বালিশ সরিয়ে, মেয়ের হাত সরিয়ে, শুতেই কানের কাছে বায়না।

"মঈশাসুর বলো!"

রোজ রাত্তিরে নতুন নতুন মইশাসুরের গল্প পাই কই বলুন দিকি। না বললে, ঘুমোতেও দেবে না। অগত্যা, যা আসে মাথায়...

“মঈশাসুরের না, কদিন ধরে দাঁতে ব্যথা। এঁ এঁ করে কান্নাকাটি করছে। দুগগামা তখন ঠিক করল দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।   

কোথায় যাবে? না সুশ্রুত ডাক্তারের চেম্বারে যাবে।“

"অ্যাঁ মা? কী বলছ? 'সুড়সুড়ি-তো' মানে?"

“না রে, সুশ্রুত। ওটা তোর মানিকমামার ভালো নাম।“

“সুশ-শুরু-তো? ইশ কী ভালো ভালোনাম। তুমি কেন এটা আমার নাম রাখোনি?

এই খেয়েছে।
“তা কেনশরণ্যাও তো কত সুন্দর...”

“না, আমি আজ থেকে সুশ্রুত হব। তুমি আমার নাম পালটে দাও।“    

সব্বোনাশ করেছে।
“ওরে ওটা ছেলেদের নাম হয়।  বয়। তুই তো গার্ল।“

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেনে নিল। গদাম করে পেটে পা তুলে দিয়ে বলল, তাপ্পর বলো।

“হ্যাঁ তো মানিকমামার কাছে যাওয়া যখন হবেই (ভয়ে আর ভাল নাম উচ্চারণ করি না), দুগগামা সবাইকেই নিয়ে চলল।“

“লক্ষী সয়োস্বোতী কাত্তিক গণেশ?

“হ্যাঁ রে সব্বাইকে সবার দাঁত দেখিয়ে আসবে চাই কি নিজেরটাও, আচ্ছা না থাকতো গেছে বুঝলি মানিকমামার চেম্বার হয়ে গেছে তখন ইয়া বড় সাদা কোট পরে ভারভারিক্কি মানিকমামা রুগী দেখছে এরা তো ঢুকে বসেছে আর মঈশাসুর দাঁতের ব্যথায় দুগগামার আঁচল এক হাতে চেপে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি পুরো
তখন মানিকমামা বলছে, ওকেই আগে নিয়ে এসো দেখি

দুগগামা তো মঈশাসুরের কান ধরে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে রুগীর চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে মঈশাসুর জল কুলকুচি করেছে মানিকমামার কথামত হাঁ -ও করেছে

এ বাবা!! এর তো আদ্ধেক দাঁত পচে গেছে রে! নিশ্চয় খালি চটচটে চকলেট বুড়ির চুল চিনি এসব খায়!! নাহ, এর তো দাঁত তুলতে হবে, গর্ত ফিলিং করতে হবে অনেক কাজ!’

এই না বলে মানিকমামা যেই না ইঞ্জেকশন দিতে গেছে...”

“ইঞ্জেকশন!!!”

“ওমা নইলে দাঁত তুললে লাগবে না? আগে তো ইঞ্জেকশন  দিয়ে অসাড় করে নিতে হয় যাতে ব্যথা না লাগে

“বেশ হয়েছে! তাপ্পর মাম্মা?   

“তাপ্পর আর বলিস না, যেই না মানিকমামা ইঞ্জেকশন বাগিয়ে এসেছে, মঈশাসুর গাঁক করে চেঁচিয়ে হাত পা ছুঁড়ে লাফিয়ে সোজা পাশের আলমারির মাথায় চড়ে বসেছে! আর সে আলমারি এত উঁচু, কারো হাত যাচ্ছে না

দুগগা মা, মানিকমামা অনেক সেধেছে , খেলনা দেব বলেছে, বই দেব বলেছে, বকেছে, ভয় দেখিয়েছে, কিন্তু সে আর নীচে নামেই না!

তখন মানিক মামা বলল, আচ্ছা থাকুক ও বসে আমি বাকিদের ততক্ষণ দেখে নিই ব্যথা যেই বাড়বে ঠিক নেমে আসবে

লক্ষ্মী তো খুবই লক্ষ্মী, দুবেলা দাঁত মাজে ওর দাঁত দেখে মানিকমামা বলল, ফাস্টো কেলাস সরস্বতীরও দাঁতও খাসা, কিচ্ছুটি নেই এমনকি কাত্তিকেরও দাঁতে গত্ত নেই, খালি একটু প্লেক হয়েছিল সে ঘষে সাফ করে দিতেই হয়ে গেল আর গণশার...” 

“গণশার তো হাতির দাঁত!”
 “হ্যাঁ হ্যাঁ, মানিকমামা বলল একে তো আমি দেখতে পারব না, আমার বন্ধু হাতির ডাক্তার, তার ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি তার চেম্বারে নিয়ে যাবেন একে

তারপরও মঈশাসুর নামে আর না! তখন দুগগা মা খুব খেপে গিয়ে, ত্রিশূলটা নিয়ে দিয়েছে তার পিঠে এক খোঁচা, আর মঈশাসুর যেই আঁতকে উঠে লাফিয়ে পড়েছে অমনি মানিকমামা টপ করে তাকে লুফে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে আর দুগগামা দশ হাতে তার হাত পা সব চেপে ধরেছে, আর মানিকমামা দিয়েছে পটাং করে ইঞ্জেকশন দিয়ে

মঈশাসুর তখন যা চেঁচান চেঁচালো না! মানিকমামার তো কানে তালা লেগে গেল, আবার বাইরে গিয়ে চাবিওলার থেকে চাবি নিয়ে তালা খুলল তারপর এসে দুটো দাঁত তুলে দিল আর বাকি গত্ত বুঁজিয়ে দিল মঈশাসুরের তো তাপ্পর মুখ ফুলে ঢোল আর কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে বাড়ি এসে দুধে ভিজিয়ে পাউরুটি খেলো আর ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেলো

এরপর আমারও কানে তালা লেগে গেছিল কিন্তু কে চেঁচিয়েছিল সেটা আমায় বলতে বারণ করা হয়েছে তবে চুপি চুপি নাম না করে বলছি, সেও পরদিন ব্রেকফাশে দুধে ডুবিয়ে পাউরুটি খাবে বলেছিল, আর তার একটু পরেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছিল