Sunday, 16 August 2020

লেখাপড়া

 

কান থেকে পট করে ইয়ারফোন খুলে চলে গেল। তারপর ফোনটাও গেল বেহাত হয়ে। ‘হি হি হি’ করতে করতে একটা ‘মোটেই আর ছোট নয় কিন্তু আসলে এক্কেবারে ছোট্ট ছানা’ মেয়ে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।

দুপুরে খেয়েদেয়ে উঠে, নিজের চেয়ারে বাবু হয়ে চড়ে বসে ল্যাপটপে টরেটক্কা করছিলুম। ছুটির দিনেও আপিশের কাজ করানোর জন্য মনে মনে বসকে কী কী সুভাষিতাবলী বর্ষণ করছিলুম সে আর নাহয় না-ই বললুম!

তাহলে কানে ইয়ে এল কোথথেকে? কিছুই না, ব্যাকগ্রাউন্ডে একটু সঙ্গীতচর্চা হচ্ছিল। মন ভালো রাখার চেষ্টা।

কথা হচ্ছে, এমনি করে চুক্কি দিয়ে পালাবে, আর আমি ছেড়ে দেব? ইয়ার্কি পায়া? অতএব ম্যাক্সি গাছকোমর করে (হ্যাঁ, হ্যাঁ, করা যায় কীভাবে যেন। মানে করতে পারি, কিন্তু বলে বোঝাতে পারব না) ধাঁই করে আম্মো দৌড়লুম পুঁচকেপানাটার পিছনে। প্রচুর কসরৎ সহযোগে, এ দরজা দিয়ে ঢুকে ও দরজা দিয়ে বেরিয়ে, এই ধরি এই ধরি এই ফসকে পালাল – এসবের পর ধরে ফেললুম খপ্‌ করে।

প্রচুর কিলবিলিনির পর রফা হল, আমি যদি কাজ ছেড়ে উঠে আসি, তাহলে আমার কাছে বসে এক রাউন্ড পড়া করতে হবে আগে, তারপর মঈশাসুরের গল্প পাওয়া যাবে।

সেইমত বইখাতা নিয়ে ঘটা করে বসা হল খাটে।

নামতার আমতা-আমতা পেরিয়ে, দাঁত খিঁচোনোর পালা শেষ করে (আজ্ঞে না। মোটেই বকাবকি করিনি। সায়েন্সে ‘দাঁত’ চ্যাপ্টার পড়ছিল, তাই বার বার আমায় হাঁ করিয়ে কোনটা মোলার, কোনটা প্রিমোলার এসবের প্র্যাকটিকাল ক্লাস করছিল।), হিন্দির বিপরীতার্থক শব্দে হাবুডুবু খেয়ে (গুগল না থাকলে কী যে করতুম আমার অনন্যসাধারণ হিন্দিজ্ঞান নিয়ে!) অবশেষে টেন্সড হওয়া গেল।

মানে ইংলিশ বই খুলে টেন্স পড়া শুরু হল আর কী!

সে এক ভয়ানক জগঝম্প ব্যাপার, যারা জানে না তাদের আগেই বলে রাখি। পাস্ট প্রেজেন্ট ফিউচার, আবার তাদের প্রত্যেকের কন্টিনিউয়াস আলাদা করে। বোঝাচ্ছি, উদাহরণ দিচ্ছি, পড়া ধরছি, তারপর গুলিয়ে ফেলেছে দেখে আবার শুরু থেকে শুরু করছি। লুপে চলল এই খানিকক্ষণ। আমার মাথায় এদিকে ‘সবই মায়া, কী বা সময়, কী বা আজ আর কী বা কাল, কাকে বলে অতীত আর কাকেই বা বলে ভবিষ্যৎ, কারণ, ওই, সবই মায়া...” ইত্যাদি বেজে চলেছে। ফলে এবার নিজেও মাঝে মধ্যে গুলিয়ে ফেলার উপক্রম করছি।

অগত্যা স্ট্র্যাটেজি পালটানো হল।

একটাই বাক্য ধরে তাকে একবার পাস্টে ফেলা হবে, একবার ফিউচারে, তারপর সেগুলোকে কন্টিনিউয়াস করে ফেলা হবে। ইট’স আ গেম, য়্যু নো!

গেমটা কিন্তু হেব্বি জমে গেছিল!

“আই ঈট পাস্তা।”

“আই এট পাস্তা।”

“আই শ্যাল ইট পাস্তা টুমরো এগেইন!”

“এই না মোটেই রোজ রোজ পাস্তা বানিয়ে দেব না আমি! এটা বল - দে গো টু স্কুল।”

“দে ওয়েন্ট টু স্কুল। কিন্তু সে তো বাজে কথা, মোটেই যায়নি, কাল তো স্কুল ছুটি ছিল!”

“আহা পাস্ট মানে গতকালই হতে হবে কে বলেছে! গত সপ্তাহে গেছিল, গত বছর গেছিল…”

এইভাবে দিব্য চলছিল। গোল করলুম একটু আরো মনোহর করতে ডাইনোসর এনে।

“বল দিকি - টেরোডাকটিলস কুড ফ্লাই।”

ব্যস, মেয়ে আর কিছুতেই তার প্রেজেন্ট বা ফিউচার করবে না! কারণ ডাইনোসর তো কবেই উল্কা পড়ে মরে গেছে, বললেই হল তাদের প্রেজেন্ট আর ফিউচার!

আমার তুম্বোমুখ দেখে তার কী মনে হল কে জানে, ফিক্‌ করে হেসে বলল, “অনেকক্ষণ আমি করেছি, এবার তুমি করো দেখি!”

দিবি? তা দে! আমি কি ডরাই সখি… ইত্যাদি প্রভৃতি…

“এমন একটা দেব না… সেটার পাস্ট, প্রেজেন্ট, প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস, ফিউচার সব হয়। সঅঅঅব”

আচ্ছা! মানে সূর্যদিকে পুবদিকে ওঠে টাইপের কিছু একটা বলবে আর কী! তা বল!

মেয়ে দেখি ফিক ফিক করে ফিচেল হাসে খালি।

তারপর দিল এই মোক্ষম একখানা সেন্টেন্স।

“তিতির ঈটস মাম্মা’স হেড!”

বইপত্তর গুছিয়ে তুলে তৎক্ষণাৎ ছুটি দিয়ে দিলুম, মশাই!

 

Sunday, 2 August 2020

সুপারহিরো

 
ছ্যাঁক্ ছোঁক্ করে আওয়াজ আসছে রান্নাঘর থেকে। রোব্বারের বেলা, বেশ কদিনের বিষ্টিবাদল পেরিয়ে আজ আকাশে ফুটফুটে আলো। নাক উঁচু করে  ঢ্যাঁড়শভাজার মনোহর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কন্যা লাফাতে লাফাতে রান্নাঘরে এসে হাজির।

"মাঁ! কীঁ কর্ছো!"

মা জানে, এটা প্রশ্ন নয়। মায়ের চুড়ো খোঁপা, কপালে বিনবিনে ঘাম, হাতে উদ্যত খুন্তি, জ্বলন্ত গ্যাস - এসবের মানে যে মা রান্না করছে, সেটা না বোঝার মত শিশু তিতির নয় আর। দেখতে দেখতে এই করোনাকালেই প্রোমোশন হয়ে ক্লাস ফোর, প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ অভিজ্ঞ মানুষ তিনি একজন। তাঁকে এদ্দূর তুলে আনতে গিয়ে এই খুন্তিধারিনীও একজন প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ মা হয়েছেন বইকি, তাই দ্রুত হাতে গ্যাস নিভিয়ে কড়াই থেকে রান্না পদার্থ পাত্রে ঢালতে ঢালতে অপেক্ষা করেন, আসল বক্তব্যের জন্য।

পরক্ষণেই সেটা শোনাও যায়, "মা! আমার সঙ্গে খ্যাঁলোঁ না!"

আজ আমার মুডটা অবিশ্বাস্য রকমের ভালো ছিল। তাই বলামাত্র রাজি হয়ে গেলুম,  "আচ্ছা চ'। কী খেলব?"

আহ্লাদে মেয়ে চারপাক নেচে এল। তারপর হাততালি দিয়ে বলল, "আমি জানি! আমরা হব... সুপারহিরো টীম!"

বেশ বেশ! অত্যুত্তম প্রস্তাব।

একটু পর। 

তিতির কীসব ব্যবস্থা করতে গেছে। আমি খাটে বসে পা দোলাচ্ছি আর খেলার পরবর্তী ধাপের অপেক্ষা করছি। তিতিরের সবেগে প্রবেশ।

"মাম্মা! পিঙ্কি টেডি হারিয়ে গেছে, রেস্ক্যু করতে যেতে হবে, চলো চলো চলো!"

রেস্ক্যু মিশন! 

তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে দুই সদস্যের টীম চলল। কই গেলি রে ছোট্ট মিষ্টি পিঙ্কি টেডি? খাটের নিচে, টেবিলের পিছনে, বালিশের তলায়...

এঘর ওঘর খুঁজে বাইরের ঘরে এসেই আমি হইহই করে উঠেছি। ওই তো টেডি! জানলার পর্দায় ক্লিপ দিয়ে ঝুলছে। একদম আমার চোখ বরাবর…!

"পাইয়াছি রে পাইয়াছি! পিঙ্কি টেডি! আর ভয় নেই, এই দ্যাখ আমরা এসে গেছি!"

কলরব করে ক্লিপ খুলে টেডিকে কোলে করে নিয়ে আসি। 

একী!

তিতিরের মুখ গম্ভীর। চোখ ছলোছলো। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় অভিযোগ, "তুমি কেন আনলে?"

আমি তো থ! 
"কেন, কী হয়েছে?"

"রেস্ক্যু তো সুপারহিরো করবে!"

আমি আরো হতভম্ব, "তাই তো রেস্ক্যু করলুম! এই যে বললি আমরা সুপারহিরো টীম!"

নাক টানতে টানতে উত্তর এল, "টীমই তো! আমি সুপারহিরো, আর তুমি আমার সাইডকিক্।"

...!!!

আর যদি কখনো জব ডেস্ক্রিপশন না জেনে কাজে যোগ দিয়েছি!

Sunday, 12 July 2020

চিঠিচাপাটি

আচ্ছা, আপনারা চিঠি লেখেন? হাতে, পেন বা পেন্সিল দিয়ে, কাগজটাগজে?

না মনে হয়। আমরা কিন্তু লিখি। আমরা মানে আমি আর তিতির। কুট্টি কুট্টি কাগজে, বিলের উলটোবাগে, আমাজনের মোড়ক-ছেঁড়া পিজবোর্ডে, এরকম যাতে হোক অহর্নিশ আমাদের চিঠি লেখালেখি হয়।

উঁহু। পেরাইভেট ব্যাপার বাপু। অমন "দ্যাঁকাও দ্যাঁকাও! বলো বলো!" করে ঝুলে পড়লেই তো আর হল না! বরং চিঠি লেখার টেকনিকটা শেখো।

বার আগে জানতে হবে, উদ্দেশ্যটা কী। মানে এমনি এমনি, নাকি কিছু একটা বায়না সুপ্ত রয়েছে অক্ষরমালার পরপারে, নাকি আড়ির পালা চলছে তাই মানভঞ্জনপ্রক্রিয়া। 

আজ্ঞে। আমরা দুজন, তিতিরের ভাষায়, যাকে বলে পরস্পরের "বেস্ট ফ্রেন্ড"। বললে পেত্যয় যাবেন না তিনি ইদানীং আমায় "ব্রো" বলে সম্বোধন করছেন, কারণ বেস্ট ফ্রেন্ডদের নাকি সেরকম সম্বোধন করাই দস্তুর। ব্যাপারটা পি জে মাস্ক না ইউনিকর্ণ কাদের থেকে শেখা হয়েছে জানি না, কিন্তু তার ফলে আমায় লাগাতার কম"ব্রো"মাইজ করে যেতে হচ্ছে। 

তো, যা বলছিলুম। বেস্ট ফ্রেন্ডরা যেমন গলাগলি করে গল্প করে, চুপি চুপি সব সিক্রেট শেয়ার করে এবং নিয়মিত ব্যবধানে ঝগড়াঝাঁটি করে কথা বন্ধ করে দেয় - আমরাও করি। হ্যাঁ ভাই, জানি আমি বুড়োধাড়ি মাম্মা, তা বলে বুড়িয়ে যেতেই হবে এটা কে বলেছে! কাজেই আমাদের মাঝেমধ্যেই মিনিট দশ বারোর মুখ দেখাদেখি বন্ধ চলে। খানিক খ্যাঁচাখেঁচির পর সাধারণত তিনি দুম দুম করে বগলে পুতুল নিয়ে রাগের চোটে আমার চটি পরেই পাশের  ঘরে চলে যান, আর আমি সাড়ে চারবার ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে নাক টেনে নিজের কাজে মন দিই।  

তারপর হয়তো মন দিয়ে নাক বেয়ে ঝাঁপ দেওয়া চশমা সামলাতে সামলাতে কম্পিতে কাজ করছি, হঠাৎ একটা ভাঁজ করা কাগজ উড়ে এসে কীবোর্ডের উপর পড়ে। ভাঁজ খুলেই দেখা যায় ভাব করার শর্ত এসে গেছে। সাধারণত এক্স সংখ্যক আদর ও হামিতেই ব্যাপার মিটে যায়। তেমন তেমন কেস হলে ললিপপের বা আইসক্রিমের ছবি থাকে। 

আবার কখনো হয়তো এমনি এমনি চিঠি আসে। বি উলটোলে ডি হয়, কিংবা জানলায় একটা কাক বসেছে, এ ধরণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবরও পেয়েছি চিঠি মারফত। আমি নিজেও যে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ খবর-টবর দিইনি তা নয়। এই চিঠি লেখা নিয়ে  বিভ্রাটও যে হয়নি এক আধবার তাও নয়। যেমন ধরুন, এটা বছরখানেক আগের কথা হবে, অসন্দিগ্ধ মা চিঠি খুলে "আই অ্যাম রেস্টিং ইন পিস" পড়ে বিষম টিষম খেয়ে ছুটে গিয়ে আবিষ্কার করেছিল ওটা পিছনে দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে বসে পা নাচাতে নাচাতে "ক্যালভিন অ্যান্ড হবস" পড়ার অবিমিশ্র আনন্দদশার তৈত্তিরীয় ইঞ্জিরি। অথবা, অনেক পাঁয়তারা মেরে চিঠি ভাঁজ করে রকেট বানিয়ে, খাটে বসে থাকা কন্যাকে দরজার আড়াল থেকে ছুঁড়ে সারপ্রাইজ ডেলিভারি করতে গিয়ে সেটা জানলা গলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবার পর মায়ের খেয়াল হয় যে ওই কাগজটার উল্টোপিঠে সদ্য আধ ঘন্টা আগেই রান্নাঘর তদারক করে তিনি মুদির ফর্দটি বানিয়েছিলেন।

কিন্তু কখনো কখনো এরকম পত্রালাপ ভারি বিমূঢ় করে দেয়, জানেন।

এই লকডাউন টাইন নেই যখন, তখনকার কথা এটা অবশ্য। নতুন বাসায় নতুনভাবে সব গুছিয়ে নিচ্ছি তখন। মেয়ের নতুন বড় সাইজের সাইকেল কিনে এনেছি গত সপ্তাহে, আবার গতকালই এসে গেছে তার নতুন পড়ার টেবিল চেয়ার - মায়ের সেটটার হুবহু কপি, খালি রং আলাদা। অফিসফেরত দেখি মেয়ে সেই সাইকেলে হু হু পাক খাচ্ছে বিকেলে, সেই চেয়ার টেবিলে বসে মন দিয়ে ছবি আঁকছে, হোমটাস্ক করছে - আর মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। তো সেদিন রাতে ঘরের আলো নিভে যাওয়ার পর, শুয়ে পড়ার পর, টের পেলুম ছোট্টটা খুব কসরৎ করে ঘুমন্ত আমার বালিশের নিচে কীসব যেন ঢোকাল। পোড় খাওয়া মা হলে যা হয়, টের পেলেও, টের পেতে দিইনি যে জেগে আছি।

পরদিন তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম কথা, "মাম্মা, তোমার বালিশটা উলটে দ্যাখো।"

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বালিশ তুলে দেখি একটা ট্যারাব্যাঁকা ছেঁড়া কাগজ, তাতে লেখা "love and kiss", আর কাল বাড়ি থেকে কাজ করার অনুরোধ, আর একটা ১০ টাকার কয়েন। 

বাকি দুটো তো বুঝলুম। কয়েনটা কেন?

জিজ্ঞাসা করে জানলুম, এই নতুন সাইকেল ও পড়ার টেবিল কিনে দিতে আমার প্রচুর টাকা খরচ হয়ে গেছে নিশ্চয়, তিনি তাই তাঁর পিগিব্যাঙ্ক থেকে বার করে এনে দিয়েছেন...লাগলে আরো দেবেন, আমি যেন একটুও চিন্তা না করি, "আরো আছে মা!"

হাসব না কাঁদব বুঝতে পারিনি জানেন। গলাটা খুব ব্যথা করেছিল খালি। বলা বাহুল্য, ও কয়েন আমার আলমারির লকারে ভেলভেটের বাক্সে তোলা আছে।

Wednesday, 20 May 2020

দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড


যে বন্ধুর ভূমির প্রেক্ষিতে আমাদের কাহিনির সূত্রপাত হইতেছে, তাহা এই দেশের অতি সাধারণ অঞ্চলগুলির একটি মাত্র। নিয়মিত বর্ষণস্নিগ্ধ সে স্থানের মাটি সরস ও উর্বর, বনানীর নিবিড় সবুজের অন্তরাল হইতে প্রভাতসূর্য উঁকি মারিয়া নিত্য তাহার কোমল রোদের পরশ বুলাইয়া দিয়া যায়। 

এমত এক সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ধরিত্রীর বুকে যদিও অনায়াসে কৃষিমাতৃক সভ্যতা গড়িয়া উঠিতেই পারত, বস্তুত তাহা হওয়াই স্বাভাবিক ছিল – কোনো অজানা রহস্যহেতু এই জমিতে অদ্যাবধি একটিও মানুষের পা পড়ে নাই। হয়তো সেই কারণেই, সভ্যতার নিবিড়তম গোপন কথাটি আজিও অতি কৌতূহলী, মুনাফালোভী বা জ্ঞানতাপস কাহারো কৌতূহলী চক্ষে ধরা দেয় নাই।
কথাটি হইল - এ অঞ্চল জনহীন, কিন্তু প্রাণহীন নয়। এই মানবচক্ষুর অন্তরালে, বসতিশূন্য অঞ্চলে অখণ্ড প্রতাপে, সানন্দে, স্বচ্ছন্দে ঘুরিয়া বেড়ায় একদল অমিতশক্তিধর জীব।

ডাইনোসর!

হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হইলেও এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।

এই পৃথিবীরই এক নিরিবিলি নির্জনে, আজিকেও সেই প্রাগৈতিহাসিক  প্রজাতির এক অনন্য শাখা অপ্রতিহত গতিতে রাজত্ব করিয়া চলিয়াছে।

তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তদ্রনুরূপ পরিবর্তিত হইতে হইতে, আদিম জাতভাইদের সহিত ইহাদের আকারে প্রকারে উল্লেখযোগ্য তফাৎ হইয়া গিয়াছে বইকি! ইহারা আকারে ক্ষুদ্রতর, ইহাদের দৈহিক গঠন তুলনায় অনেক পেলব ও নমনীয়। প্রাচীন ডাইনোসর হয় সম্পূর্ণ মাংসাশী, নতুবা বিশুদ্ধ নিরামিষাশী হইত। কিন্তু ইহারা সর্বভুক। সেইসঙ্গে ইহারা বুদ্ধিমান, বলিষ্ঠ, সুকৌশলী, ক্ষিপ্র এবং সংযমশীল। তবে সর্বাধিক আশ্চর্য এদের শৃঙ্খলাবোধ ও দলবদ্ধতা। ইহারা যখন যেস্থলে যায়, সকলে একসঙ্গে যায়। সর্বদা সারি বেঁধে চলাফেরা করিয়া থাকে, একজনের কিছুমাত্র বিপদে অন্যরা সবাই আগাইয়া আসে সাহায্য করিতে। খাদ্যদ্রব্য যাহা পায়, সকলে মিলিয়া ভাগ করিয়া খায়। সবচাইতে বড় কথা, মনান্তর বা মতান্তর হয় কিনা জানা নাই, কিন্তু হইলেও কখনো দলমধ্যে কেউ অন্য কারো সহিত বিবাদ করে না।

ইহাদের দেখিলে মাঝেমধ্যে মনে হইবে, সভ্যতার যথার্থ প্রসার মানবসমাজের পরিবর্তে ইহাদের মধ্যেই অধিক গতিতে হইয়াছে।

আপাতত, দলটি বিক্ষিপ্তভাবে তৃণভূমিতে অলস পদচারণা করিতেছিল। ইহাদের পারস্পরিক ভাব বিনিময় বোঝার ক্ষমতা যদি আমাদের থাকিত, তাহা হইলে হয়তো বা শুনিতে পাইতাম যে ইহারা আসন্ন বর্ষাঋতুর নিমিত্ত খাদ্যসঞ্চয় করিয়া রাখা লইয়া আলোচনা করিতেছে।

সহসা বিনা মেঘে বজ্রপাততুল্য এক ঘটনা ঘটিল। আকাশ হইতে তাহাদের মাথার উপর শুভ্র, কঠিন বরফের ন্যায় খণ্ড খণ্ড কী যেন ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দলের সকলেই প্রথমে এই আকস্মিক আবির্ভাবে ভীত হইয়া দৌড়াদৌড়ি করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, যে যেখানে সম্ভব, উচ্চাবচ ভূমির খানাখন্দে লুকাইয়া পড়িতেছিল প্রাণরক্ষার তাগিদে।

যেমনই আচমকা এই শ্বেতখণ্ড ধারাপাত শুরু হইয়াছিল, তেমনই আচমকা তাহা আবার থামিয়াও গেল কিছুক্ষণ পরে। তখন লুক্কায়িত স্থান হইতে এক এক করিয়া আমাদের গল্পের মূল চরিত্ররা উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল। তৎপরে আকাশে তেমনই নির্ভার নীলিমা, তরুলতাগণ তেমনই সবুজ সতেজ, চারিদিক তেমনই নিঃশব্দ নির্জন - দেখিয়া দুঃসাহসী কয়েকজন সতর্ক পদক্ষেপে বাহির হইয়া এল। তাহাদেরই একজন, মুখ তুলিয়া বাতাসে কিসের যেন গন্ধ শুঁকিল।

অতঃপর চকিতে ছুটিয়া গেল অপেক্ষাকৃত নিকটস্থ একটি শ্বেতখণ্ডের দিকে।

এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত, তাহার পর তাহার দিক হইতে দলের বাকিদের প্রতি যে ইঙ্গিত প্রদত্ত হইল, তাহার ভাষা আমরা না বুঝিলেও সে যে পরম উৎফুল্ল, তাহা বুঝিতে বাকি থাকে না।

সঙ্গে সঙ্গে প্রবল এক হর্ষের জোয়ার বহিয়া যাইল যেন সেই ভূমিখণ্ডে। সেটা স্বাভাবিকও অবশ্য, খাদ্য সংগ্রহের ভাবনা শুরু করিবামাত্র যদি এইরূপ শূন্য হইতে খাদ্য বর্ষণ হয়, কে না উল্লসিত হইবে? যথার্থ, ঐ শ্বেতখণ্ডগুলি এই প্রজাতির ভক্ষণযোগ্য, শুধু তাহাই নহে, অতি স্বাদু, অতি মনোরম খাদ্য। এই অকল্পনীয় সৌভাগ্যে তাহাদের উচ্ছ্বল আনন্দ, উদ্বেল চঞ্চলতা দেখে কে!

খণ্ডগুলি অবশ্য আয়তনে তাহাদের শরীর হইতেও বড়। কিন্তু তাহাতে ইহাদের কিছুমাত্র দমিয়া যাইবার লক্ষণ দেখা গেল না। কেহ একাই, কেহ বা দুইজনে মিলিয়া ধরিয়া, অটুট ধৈর্যের সহিত ধীরে ধীরে, এক এক করিয়া খণ্ডগুলি তাহাদের গোপন খাদ্যভাণ্ডারে লইয়া যাইতে শুরু করিয়া দিল। ক্রমে ক্রমে সবগুলিই নির্বিঘ্নে স্থানান্তরিত হইয়া গেছে, আর একটি কি দুটি পড়িয়া আছে মাত্র, হেন কালে...

“অ্যাই!!! আমার চিনির কৌটো নিয়ে ওখানে কী করছিস?”

“হুশ্‌! মা, আস্তে! খেতে দিচ্ছি।“

“কাকে আবার চিনি ছড়িয়ে খাওয়াচ্ছ এখন! দেখি?”

জানলার ধাপিতে কয়েকটা গাছের টব। এবড়ো খেবড়ো মাটি, যেমন হয়। মেয়ের পোঁতা ছোলাগাছগুলো সবে মাথাচাড়া দিচ্ছে। মা মেয়ের পিছন থেকে মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখে সেই মাটিতে একটি দুটি চিনির দানা তখনো পড়ে, আর ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল কালো কালো ...

“দেখেছ মা? আমি পুষেছি! ওদের নাম কী বলো তো? চিটিসরাস!”


Saturday, 28 March 2020

বাড়ি



বহু কষ্টে বিদ্যাটি আয়ত্ত করছিলুম জানেন! এমনি এমনি নয়, একটা আস্ত আখাম্বা চারতলা প্রাসাদোপম বাড়ি বানানোকে কেউ এমনি এমনি কাজ বললে তার কানে গুজিয়ার প্যাঁচ মেরে গায়ের  উপর  আঠেরো পিস বুভুক্ষু ছারপোকা ছেড়ে দেব বলে দিলুম!

সে কি যে সে বাড়ি! সে বাড়ির একতলায় আছে ‘প্রাসাদোপম’ ( শব্দটা বলে ফেলে মহা ভুল করেছি! সব কিছুতেই এই বিশেষণটা না লাগালে, তিনি গোঁসা হচ্ছেন।) “বাথথুম্‌”।

প্রচুর আপত্তি করেছিলুম জানেন। এটা মেনে নেওয়া যায়? বাড়িতে ঢুকেই “বাথথুম”! মানে, কল্পনা করুন, আপনি বন্ধুর বাড়ি গেলেন, বেল বাজালেন, হাসিমুখে বন্ধু এসে দরজা খুলল, আপনি ভিতরে ঢুকেই হয় বাথটাব নয় কমোডে গুঁতো খেলেন? এরকম বাসায় ঢুকেই গোসলখানায় পদার্পণ করতে লোকে গোঁসা হবে না?!

তা আর্কিটেক্ট পাত্তাই দিল না। ওটাই নাকি তার ডিজাইন।

সুতরাং হল বাথথুম। সত্যিকারের জল ভরা বাথটাব দিয়ে। (ফোঁস! বাক্সটায় চুলের ক্লিপগুলো রাখতুম, সেগুলো আর বাক্সের ঢাকনা কোথায় গেল পরে খুঁজতে হবে আবার!)

তার উপরতলায় খাবার ঘর। কুট্টি কুট্টি কাঠের টেবিল চেয়ার, গত জন্মদিনে কিনে দিয়েছিলুম। তার উপরে একটা ধুমসো কেকের শেপের মোমবাতি – জ্বালা হবে, না খাওয়া হবে তা নিয়ে অনেকক্ষণ অবধি দ্বিমত চলছিল, শেষমেশ ঠিক হয়েছে দিনের বেলা খাওয়া হবে আর সন্ধেবেলা জ্বালা হবে। কে বলেছে  you cannot eat your cake and have too!

খাবার ঘরে একটা পিঙ্ক বাহারি আলমারি রাখা হয়েছে। ওটা দরকার মত ফ্রিজ, ওভেন বা খাবার তুলে রাখার র‍্যাক ভেবে নিতে হবে। এসব সামান্য অ্যাডযাস্টমেন্ট যদি না পারেন তো খেলতে আসেন কেন মশাই! দেখুন, দেখে শিখুন। এইমাত্র আমি আলমারি (ফ্রিজ) থেকে পাস্তা বার করে, আলমারিতে (ওভেনে) গরম করে আলমারিতে (র‍্যাকে) তুলে রাখলুম। অবশ্য র‍্যাক থেকে নামানোর সময় ওটা পাস্তা থেকে খিচুড়িও হয়ে যেতে পারে। সে যাক!

উপরে চলুন। তিনতলা হচ্ছে শোবার ঘর। খাট, বিছানা, দুটো অতি নয়নমনোহর বাহারী ‘পাপ্পল কালারের’ সোফা্‌, একটা ততোধিক বাহারি গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, একটা হেলে পড়া নারকেল গাছ।

মকানো নিষিদ্ধ। ওটাই আর্কিটেক্টের ডিজাইন।

কে বলেছে এমন হয় না? এককালে ‘ওরাকল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস’এ কাজ করতুম। গোরেগাঁওতে তাদের অফিস বিল্ডিং-এর মাঝামাঝি একটা ফ্লোর ওপেন,গুচ্ছের  এইরকম চমৎকার পাম গাছ টাছ আছে। এখনো আছে, ওদিক দিয়ে গেলে দেখতে পাই। তা, অফিস লবিতে যদি হতে পারে, বাড়ির শোবার ঘরেই বা না হবে কেন বাপু!

তবে, ঘুমোতে ঘুমোতে মাথায় যদি নারকেল খসে পড়ে, এই বলে আমি একটু ক্যাঁওম্যাও করেছিলুম। তিনি ভারি নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, এটার নারকেল খসে পড়ে না, কেটে পাড়তে হয়।

হবেও বা। আর কথা বাড়াইনি, যা মেয়ে, বেশি বললে হয়তো গাছের ডগায় ফেভিকল মাখিয়ে বসে থাকবে। তারপর সে প্লাস্টিকের নারকেল গাছ আমার ড্রেসিং টেবিলে জন্মের শোধ আটকে যাবে...থাক তার চেয়ে!

এই অবধি খাসা চলছিল বুঝলেন। তিনি হুকুম করছেন হাত পা নেড়ে আর আমি স্যাটাস্যাট মালপত্তর ফিট করছি। আর একটাই তলা বাকি ছিল , চারতলা, টপ ফ্লোর।

“এটা।“

হাতে নিয়ে মুহ্যমান হয়ে থাকি একটু। প্লাস্টিকের গাছে ল্যাজঝোলা পাখি, আসলে ফ্রুট ফর্কের সেট। ভারি শখ করে হাতিবাগান থেকে কিনেছিলুম। হাতে গোনা কয়েকদিন খাবার টেবিলে থাকার পর আশ্চর্যজনক ভাবে গাছটা উধাও হয়ে যাওয়ার পর, খুব স্বাভাবিকভাবেই পাখিগুলো কন্যার খেলনার ঝুড়িতে ঠাঁই পেয়েছিল। এদ্দিন পরে আমার হাতে আবার সেই গাছটা!

“আরে, রাখো ওটা? উঁহু উঁহু ওদিকে না, এদিকের দেওয়ালে , এই এই এইরকম করে।“
প্রায় আমার ভুঁড়ি বেয়ে উঠে সেটা ঠিক করে সেট করা হল।

আমি ভাবছি এবার পাখি বসবে বুঝে ডালে ডালে। ওমা, একটা ধুমসো লাল গাড়ি হাতে ধরিয়ে দিল।

“রাখো?”

“ইকী! গাড়ি এত উপরে থাকে না! ইকী! না না…”

কে শোনে কার কথা। ওইটেই নাকি গ্যারেজ। ওখানেই গাড়ি রাখতে হবে।

“নামবে কী করে? রাস্তায় চলতে হবে তো!”

“আহ মা! ব্যাট্মোবাইল দ্যাখোনি? এই তো এইরকম ডানা খুলবে (গাড়িটা দরজা খোলা যায় দেখে আমিই কিনেছিলুম বটে) আর হুশ্‌ করে উড়ে যাবে!”

যাক তবে। উড়েই যাক। আমার এমনিতেই হুঁশ উড়ে যাচ্ছে। কথা না বাড়িয়ে গাড়ি রেখে দিই।                                                                                                                       
তারপর দুজনের একসঙ্গে খেয়াল হয়।

ও মা, সিঁড়ি?”

“এই, উঠবে কী করে?”

এগিয়ে পিছিয়ে, এদিক ওদিক থেকে মন দিয়ে অবলোকন করি। না, সিঁড়ি বলে চালানোর মত কিছু চোখে পড়ে না।

তারপর মাথায় বুদ্ধি আসে। দুটো খালি কৌটো, একফালি লম্বা উলের দড়ি, দুটো রাবার ব্যান্ড।

নে, তুই আমায় ব্যাটমোবাইল দেখাচ্ছিস, আমি তোকে অরণ্যদেবের গাছবাড়ির ঝুড়ি লিফট করে দেখালুম। এবার লিফটে চেপে যত খুশি ওঠানামা করা পুতুলদের।

এইবার, আমাদের বাড়ি কিন্তু রেডি!! হেব্বি হয়েছে, যাই বলো! বাড়ির বাসিন্দা দুই ঝুঁটিবাঁধা কুট্টি কুট্টি পুতুলও এসে গেছে! তবে তারা এবার জামা টামা খুলে বাথটাবে ‘চাং’ করবে, তোমরা ধেড়েরা এখন এখান থেকে যাও দিকি!